বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা চিকিৎসায় সংকট

  •    
  • ২৪ মার্চ, ২০২২ ০৮:৫৯

সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘বিনিয়োগ করি যক্ষ্মা নির্মূলে, জীবন বাঁচাই সবাই মিলে’। এ উপলক্ষে সকালে রাজধানী ঢাকাসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

মাদারীপুরের বাসিন্দা ইয়াকুব আলী লেখাপড়া শেষে চাকরি না করে ব্যবসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। নিজের জমিতে একটি মুদি ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা তার এই উদ্যোগে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চার বছর আগে ইয়াকুবের শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু ধরা পড়ে। স্থানীয়ভাবে দুই মাস ওষুধ খান। একটু সুস্থ হতেই ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেন। সেই ওষুধে পুরোপুরি যক্ষ্মা ভালো হয় না। কিছুদিন পর শারীরিক অবস্থা আরও গুরুতর হয়ে পড়ে।

শেষ পর্যন্ত ঢাকায় এসে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হন ইয়াকুব। প্রথমবার দুই মাস সেবা নিয়ে একটু সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়েন। কিন্তু ৯ মাস পর আবার সমস্যা দেখা দেয়। আবারও জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। দ্বিতীয় দফা দুই মাস হাসপাতালে অবস্থান করে একটু সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেও যক্ষ্মা তার পিছু ছাড়ে না। তৃতীয় দফায় দুই মাস ধরে তিনি একই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা যায়, ওষুধ প্রতিরোধী (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট-এমডিআর) যক্ষ্মায় আক্রান্ত তিনি। ওষুধের ডোজ পুরো না করে ছেড়ে দিলে এটি আবার ফিরে আসে।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ না দেয়া, মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দেয়া এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত না হওয়ায় ইয়াকুবের নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে। অনিয়মিত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তিনি এমন পরিস্থিতির শিকার।

ইয়াকুব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাদারীপুরে যথাযথ চিকিৎসাসেবা না থাকায় আমারর মতো অনেক রোগীকেই প্রতি মাসে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে আসতে হয়। এতে রোগীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্য বলছে, ‘সারা দেশে যক্ষ্মা শনাক্তকরণে ৪৯০টি জিন এক্সপার্ট যন্ত্র, ১ হাজার ১১৮টি অণুবীক্ষণ যন্ত্র এবং ১৮৭টি ডিজিটাল এক্স-রে যন্ত্র রোগ পরীক্ষা ও চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে ওষুধ প্রতিরোধী (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট-এমডিআর) যক্ষ্মায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দেশের ৮টি বিভাগে দেয়া হচ্ছে। জনসংখ্যার বিষয়টি মাথায় রেখে ঢাকায় দুই জায়গায় এই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। একটি শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতাল, অন্যদিকে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে।

সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে যক্ষ্মা রোগের ভালো চিকিৎসাসেবা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। জেলা ও উপজেলা শহরে চিকিৎসা এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলে রোগীদের এতটা ভোগান্তি পোহাতে হতো না।

জেলা পর্যায়ে শুধু প্রাথমিক কফ পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এমডিআর পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে এমডিআর যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যক্ষ্মা জটিল পর্যায়ে গেলে এমন সমস্যা দেখা দেয়। গ্রামের মানুষ এতটা সচেতন নয়। যে কারণে নিয়মিত ওষুধও খায় না।

‘রোগীদের প্রথম ছয় মাসের চিকিৎসায় কেউ অনিয়মিত ওষুধ সেবন করলে অথবা চিকিৎসা পদ্ধতিতে ভুল হলে এমডিআর যক্ষ্মা হয়। এমডিআর রোগীর ছোঁয়ায় আরেকজনের এ রোগ হতে পারে। এ রোগ ধরা পড়লে টানা ২৪ মাস চিকিৎসাধীন থাকতে হয়।’

ডা. খুরশীদ আলম আরও বলেন, ‘বিশেষত গ্রামাঞ্চলে কাশীর মতো উপসর্গ দেখা দিলে রোগীরা সাধারণত স্থানীয় হাতুড়ে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভুল চিকিৎসার শিকার হয়। এমন হতে হতে রোগটা জটিল পর্যায়ে চলে যায়। তখন ফুসফুসে ফাইব্রোসিস বা আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

‘তবে আমাদের নেট‌ওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দ্রুত শনাক্ত ও পুরোপরি চিকিৎসা দেয়া। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত হলে দ্রুত সুস্থ করা সম্ভব। তাতে করে অন্য কারও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিও কমে আসে।’

৯৬ শতাংশ শিশু যক্ষ্মা রোগীই শনাক্তের বাইরে

দেশে মোট শিশুর ৪ দশমিক ৫ শতাংশ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত। তবে এসব শিশুর ৯৬ শতাংশই শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। যক্ষ্মা রোগ নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত বা কার্যকর ব্যবস্থাপনা না থাকা, ডায়াগনস্টিক সুবিধার অপ্রতুলতা, শিশু চিকিৎসক সংকট, শুরুতে কোনো উপসর্গ না থাকা, উপজেলা পর্যায়ে শিশুদের যক্ষ্মা রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকাই এ ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ। করোনার আগে বছরে শনাক্তের ১২ শতাংশ শিশু পাওয়া গেলেও করোনার মধ্যে এই কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

দেশে মোট শিশুর ৪ দশমিক ৫ শতাংশ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত। তবে এসব শিশুর ৯৬ শতাংশই শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফাইল ছবি

নিজেদের সীমাবদ্ধতা কথা শিকার করেন যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বড়দের দুই সপ্তাহের বেশি কাশি থাকলে আমরা তাদের কফ পরীক্ষা করে শনাক্তের ব্যবস্থা করি। অন্যদিকে শিশু রোগীদের যক্ষ্মা শনাক্ত করাটা সাধারণ মাঠকর্মীদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। এ জন্য শিশু বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন হয়।

‘যক্ষ্মার সংক্রমণ রোধে করণীয় সম্পর্কে মাঠকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া আছে। আক্রান্তদের সংস্পর্শে থাকা শিশুদের পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। যেমন একজন মা যক্ষ্মা আক্রান্ত হলে তার সন্তান যদি বুকের দুধ পান করে তবে তাকেও পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে।’

লক্ষমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে যক্ষ্মা শনাক্ত

২০২১ সালে সারা দেশে ৩ লাখ ৩২ হাজার রোগী শনাক্তের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বছর শেষে ৩ লাখ ৭ হাজার ৪৪৪ জন রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তবে যারা শনাক্ত হয়েছে তাদের চিকিৎসা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। শনাক্ত ৯৭ শতাংশ রোগী‌ই সুস্থ্ হয়েছে, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ ভালো।

তবে বছরে কতজন মারা গেছে, সেই তথ্য জানাতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, দেশে যক্ষ্মায় দিনে ১৮৫ জন মারা যাচ্ছে। আর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠছে ৯৭ শতাংশ রোগী।

বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস আজ

এই পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘বিনিয়োগ করি যক্ষ্মা নির্মূলে, জীবন বাঁচাই সবাই মিলে’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে বিশ্বনেতারা বেশকিছু বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০৩৫ সালের মধ্যে সেসব প্রতিশ্রুতি পূরণ করার কথা। অন্যান্য বছরের মতো এবারও জাতীয়ভাবে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালন করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

দিবসটি উপলক্ষে আজ সকালে রাজধানী ঢাকায় শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একই ধরনের কর্মসূচির আয়োজন রয়েছে।

করোনার বাধা কাটিয়ে উঠছে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। শুরুর দিকে এই মহামারি জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করে। একদিকে মানুষ সেবা নিতে কম আগ্রহ দেখায়, অন্যদিকে স্বাস্থ্যকর্মীরাও সেবাকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকে।

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মূল্যায়ন বলছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে সব ধরনের প্রশিক্ষণ স্থগিত হয়ে যায়। স্থানীয় অঘোষিত ‘লকডাউন’ ও যানবাহন স্বল্পতায় কিছু কর্মী কর্মস্থলে উপস্থিত হতে পারেননি। কফ সংগ্রহ বা রোগ শনাক্তকরণও স্থগিত হয়ে যায়। একই কারণে জেলা পর্যায়ের সব পাক্ষিক সভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বাধা কাটিয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে দেশে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয় ৭১ হাজার। তবে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর মার্চ থেকে পরের তিন মাসে শনাক্ত সংখ্যা অর্ধেকেরও কমে নেমে আসে। এপ্রিল, মে ও জুন- এই তিন মাসে রোগী শনাক্ত হয় মাত্র ২৮ হাজার ২৪৬ জন। এরপর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে এলে পুরোদমে কাজে নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। করোনার বাধা কাটিয়ে উঠে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়।

এ বিভাগের আরো খবর