‘টাকা-পয়সা নেই, ছেলেরা দেখে না। কী খাব। কষ্টের তো শেষ নেই। নাম তো অনেকবার লিখল, অনেকবার ছবি তুলে নিয়ে গেল। কই কিছুই তো পাইনি।’
কথাগুলো বলছিলেন ‘বাঘ বিধবা’ সোনামণি। দুই স্বামীকে বাঘে নেয়ার কারণে এই নামটি এখন অনেকের কাছেই পরিচিত।
মূলত যাদের স্বামী বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন, স্থানীয়ভাবে তাদের বলা হয় ‘বাঘ বিধবা’।
দক্ষিণাঞ্চলের শেষ জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা মুন্সীগঞ্জ গ্রামের জেলেপাড়ায় তার বাড়ি। স্বামীকে বাঘে নেয়ার দায় নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে জীবন।
সোনামণি জানান, ১৯৯৯ সালে তার স্বামী রাধাকান্ত সরদার বন বিভাগের অনুমতিপত্র নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়েন। পরে আর জীবিত ফিরে আসেননি। স্বামীর লাশ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি সঙ্গীরা।
নিমিষেই সংসার তছনছ হয়ে যায় তার। সোনামণি কীভাবে সংসার চালাবে তা ভেবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সে সময় স্বামীহারা একজন নারীকে অবহেলার চোখে দেখা হতো।
তিনি জানান, দেবরের সংসারে থাকতে অনেক ধরনের কথা শুনতে হয়েছে। বাবার সংসারেও জায়গা হয়নি তার। প্রতিবেশীরা অপয়া, স্বামী খেকো, অলক্ষ্মী বলে ধিক্কার দিতেন।
একপর্যায়ে অবিবাহিত দেবর ভূবেন সরদারের সঙ্গে সোনামণির দ্বিতীয় বিয়ে হয়। ভূবেনও সুন্দরবনে মাছ ধরে উপার্জন করতেন। তখন সোনামনির দুঃখ কিছুটা কমে। এ সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ে হয় তার।
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পরপরই ভূবেন বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরার জন্য গেলে বাঘের আক্রমণে মারা যান। প্রথম স্বামীর মতো লাশ ফিরিয়ে আনতে পারেনি সঙ্গীরা।
দ্বিতীয় স্বামীকে হারিয়ে সোনামণির ঠাঁই হয়নি শ্বশুরবাড়িতে। সন্তানদের বাঁচানোর জন্য লোকের বাড়িতে কাজ করে, মাছ ধরে সংসার চালান। ছেলেমেয়েরা বড় হতে থাকে। নিজের আয়ের টাকায় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল সুখী হওয়ার।
ছেলেরা বড় হলে তাদেরও বিয়ে দেন সোনামণি। পরে সংসারে বনিবনা না হওয়ায় তারা পৃথক হয়ে যান।
জমি বলতে জেলেপল্লিতে ছোট এক কুঠিঘর। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু ছাড়া কিছু নেই। এই পরিস্থিতিতে সোনামণি বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা চালান।
সোনামণির অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা করা হয়নি। আমাদের বলা হয়েছিল ২০০২ সালে যাদের স্বামী মারা গেছে তারা অনুদান পাবেন। আমাদের ফরেস্টার অফিসে আবেদন করতে বলা হয়েছিল। আবেদন করেছিলাম, কিন্তু কোনো সহযোগিতা করা হয়নি।
উপজেলার সোরা গ্রামের স্বরবানু খাতুনের স্বামী বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন ২২ বছর আগে। ছবি: নিউজবাংলা
‘এখন আমার থাকার জায়গা নেই। সরকার থেকে যদি আমার একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে খুবই ভালো হতো।’
শ্যামনগরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে এমন অনেক ‘বাঘ বিধবা’ নারীর সঙ্গে দেখা মেলে। কেউ মাছ ধরতে গিয়ে, কেউ মধু আহরণ করতে, কেউ আবার কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। উপকূলের নারীদের গল্পগুলো প্রায় একই রকম।
উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের ৯ নম্বর সোরা গ্রামের স্বরবানু খাতুনের স্বামী বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন ২২ বছর আগে। তিনি বলেন, ‘আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। স্বামী যখন জীবিত ছিল তখন আমাদের জায়গা ছিল, জমি ছিল, সেখানে সবজি হতো, ধান হতো। ঝড়ে লবণ পানির কারণে আমাদের সবকিছু নষ্ট হয়ে যায়। তারপরে ছেলে-মেয়েদের খাদ্য, বাসস্থান সবকিছু সংকুলান হতো না জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায়। আমার স্বামী বন বিভাগের অনুমতিপত্র নিয়ে সুন্দরবনের মধু ভাঙতে যায়। সেখানে বাঘের আক্রমণে মারা যায়।’
তিনি বলেন, ‘এরপর শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। সে সময় শাশুড়ি বলত, ‘অপায়া, অলক্ষ্মী, ডাইনি, তোর কারণে আজ আমার ছেলেটাকে জঙ্গলে বাঘে খেয়েছে। আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা।’ এসব কথা বলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ছেলেমেয়ের হাত ধরে বাপের বাড়ি চলে আসি।’
স্বরবানু খাতুন বলেন, ‘আসার পরে বাপের বাড়িতেও আমাদের জায়গা হয় না। ভাবি বলে স্বামীকে বাঘে খাওয়াইছে, আমাদেরও খাওয়াবে- এই বলে আমাদের বের করে দেয়।
‘বাঘ বিধবাদের কেউ মূল্যায়ন করে না। চেয়ারম্যান, মেম্বারের কাছে গেলে বলে তোদের কতজনকে বাঘে খাবে, আর কতজনকে আমরা দেখব। তোদের মতো তোরা কাজকর্ম করে খা।’
তিনি বলেন, ‘এত দিন আমরা আশায় ছিলাম সরকার আমাদের বাঘ বিধবাদের জন্য কিছু করবে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমরা বাঘ বিধবারা সব জায়গা থেকে অবহেলিত। আমাদের জন্য সরকারিভাবে যেন একটা উদ্যোগ নেয়া হয়।’
একই গ্রামের মরিয়ম খাতুন বলেন, ‘১৮ বছর আগে আমার স্বামী সরকারি পাস নিয়ে জঙ্গলে গিয়েছিল। সেখানে বাঘের আক্রমণে নিহত হন। সরকারিভাবে পাস নিয়ে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হলে সরকারিভাবে অনুদান পায়, কিন্তু আমি একটি টাকাও পায়নি। মাঝেমধ্যে কিছু এনজিও ঈদের সময় চাল, ডাল দিয়ে একটু সহযোগিতা করে, তবে সেটা সীমিত। আগে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতাম। এখন বয়সের কারণে আর পারছি না।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশের পর কোনো বনজীবী বাঘের আক্রমণে হতাহত হলে বন বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক অনুদানের নিয়ম রয়েছে।
যার নামে বোর্ডের লাইসেন্স করা থাকে তারা এটা পায়, যার নামে লাইসেন্স নেই সে বাঘের আক্রমণে নিহত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকারি অনুদান পায় না।
কী বলছেন জনপ্রতিনিধি
শ্যামনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম আতাউল হক দোলন বলেন, ‘সুন্দরবনের উপকূলীয় সাধারণ মানুষ জীবন নির্বাহের জন্য অবৈধভাবে বনের ভেতর প্রবেশ করে। এতে বাঘের আক্রমণে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। বাঘের আক্রমণে নিহতের স্ত্রীকে আমরা একটা নাম দিয়েছি বাঘ বিধবা।
‘আমাদের শ্যামনগর উপজেলায় সাড়ে ৩০০ থেকে পৌনে ৪০০-র মতো বাঘ বিধবা রয়েছে। সরকারি যেসব বরাদ্দ আসে, আমরা তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দিয়ে থাকি।’
তিনি বলেন, ‘আমি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে একটি অনুদানের ব্যবস্থা করেছি। উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বাঘের আক্রমণে নিহতদের পরিবারে ১০ হাজার টাকার বরাদ্দ দেয়।
‘বিভিন্ন এনজিও, সংস্থাগুলো বাঘ বিধবাদের বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি সরকারি সহায়তায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে একটি বরাদ্দ দেয়া হয়। যার নামে বোর্ডের লাইসেন্স করা থাকে, তারা এটা পায়। যার নামে লাইসেন্স নেই সে পায় না। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, যে ব্যক্তি নিহত হয় সেই ব্যক্তিকে যেন ক্ষতিপূরণটা দেয়া হয়।’
শ্যামনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রজ্ঞাপন আসছে কি না আমি জানি না। তবে এটি অচিরেই চলে আসবে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ধরনের অসহায় পরিবারের জন্য আরও সরকারি সহায়তা দেয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’
বন কর্মকর্তার ভাষ্য
এদিকে যার নামে বোর্ডের লাইসেন্স করা থাকে তারা সরকারি অনুদান পায়, যার নামে লাইসেন্স নেই সে বাঘের আক্রমণে নিহত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকারি অনুদান পায় না- এমন কিছু জানেন না সুন্দরবনে সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক কে এম হাসান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী তারা কাগজপত্র জমা দিলে ৩ লাখ টাকা করে পায়। আগে ছিল ১ লাখ, এখন ৩ লাখ টাকা করে পায়। গত ১৫ তারিখের অনুষ্ঠানে ১ জনকে আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন কোনো কিছু তো নাই। আইনে আছে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই টাকা পাবে। তার নামে পাস থাকলে বা সে যদি সহযোগী হিসেবেও যায়, একজন মৃত ব্যক্তির সহযোগী হিসেবে গেলেও সে টাকা পাবে। এখন কার নামে বোর্ড আছে, কার নামে লাইসেন্স আছে, এটা তো দেখার বিষয় না। পাশে কার নাম আছে, সেটাই দেখার বিষয়।’