বিদেশি ঋণসহায়তায় নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন (৬০০কোটি) ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ।
বর্তমান বিনিময়হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ২০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৯ শতাংশ বেশি।
এর আগে আট মাসে এতো বেশি বিদেশি ঋণসহায়তা কখনই আসেনি দেশে।
‘এই ধারা অব্যাহত থাকবে‘ আশা প্রকাশ করে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, ‘অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এবার অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণসহায়তা ৯ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছবে।’
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বুধবার বিদেশি ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি ও ছাড়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বাংলাদেশকে ৪৮৪ কোটি ৫৩ লাখ (৪.৮৪ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। পাওয়া গেছে ৫৮৯ কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার (৫.৯ বিলিয়ন) ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি দাতারা বাংলাদেশকে যে ঋণসহায়তা দিতে চেয়েছিল তার থেকেও ২২ শতাংশ বেশি ছাড় করেছে। বিদেশি ঋণসহায়তা প্রাপ্তিতে এমনটা খুব কমই দেখা যায়।
ছাড় করা ঋণসহায়তার মধ্যে ৫৭৪ কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজার ডলার পাওয়া গেছে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে। ১৫ কোটি ৬৫ লাখ ৯০ হাজার ডলার অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার খাদ্য অনুদান এবং ১৫ কোটি ৪০ লাখ ৬০ হাজার ডলার প্রকল্প অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৩৭৩ কোটি ৬২ লাখ ৬০ হাজার (৩.৭৩ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করে দাতারা। সে হিসাবেই এই আট মাসে বিদেশি ঋণসহায়তা বেড়েছে ৫৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।
প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ২২.২৫ শতাংশ
ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৩৯৬ কোটি ৩২ লাখ ৪০ হাজার (৩.৯৬ বিলিয়ন) ডলারের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সেই প্রতিশ্রুতির চেয়ে ২২ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার করেছে।
করোনা মহামারির ধাক্কা দ্রুত সামলে উঠতে দাতারা ঋণসহায়তা বাড়িয়েছে বলে জানান অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
স্বস্তিতে সরকার
সংকটের সময়ে বেশি ঋণ পেয়ে খুশি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো ঋণ অনুমোদন করছে দাতারা; পেয়েও যাচ্ছি তাড়াতাড়ি। সত্যি বলতে কি, আমরা যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। এতে করোনার টিকা খাতে ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ মেটাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে দ্রুত ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে। আমরা আমাদের প্রয়োজনের বিষয়টি তাদের ভালোভাবে উপস্থাপন করেছিলাম। তারা দ্রুত সাড়া দিয়েছে; এখনও দিচ্ছে। সে কারণে করোনার ধাক্কা সামলে খুব দ্রুতই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি; যা বিশ্বের অনেক দেশই পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘চলমান প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি করোনা মোকাবিলার জন্যও মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়া গেছে। এখনও পাওয়া যাচ্ছে; ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।
‘এই ঋণসহায়তা এবং আমাদের সরকারের দেড় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানা উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব যতটা পড়ার কথা ছিল, ততটা পড়েনি।’
শামসুল আলম বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি করোনার আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। রপ্তানি-আমদানিসহ অর্থনীতির সব সূচকই এখন ভালো। সব মিলিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, করোনা মহামারি আমরা ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছি।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশি ঋণ কোভিড মোকাবিলায় সরকারকে যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে। পরপর দুই বছর ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ফরেন এইড অবাক করার মতো; চলতি অর্থবছরেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।
‘এই কঠিন সময়েও সরকারকে কোনো ধরনের অর্থসংকটে পড়তে হয়নি। উন্নয়নকাজ থেমে থাকেনি; টিকা কিনতে সমস্যা হয়নি।‘
এসব কারণেই বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে করছেন আহসান মনসুর।
দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘মহামারিকালে বাজেট সহায়তা এবং টিকা কেনার জন্য ঋণের কারণেই বিদেশি ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় বেড়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পে যে ঋণ দেয়া হয়, তার ছাড় হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়নের ভিত্তিতে। বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত হলে অর্থছাড়ও হয় দ্রুত। আবার প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হলে অর্থছাড়ও বিলম্বিত হয়। তবে করোনার টিকা কেনার ঋণ এবং বাজেট সহায়তার ঋণ চুক্তি হওয়ার বা প্রতিশ্রুতি পাওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ছাড় হয়।’
ইআরডির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের এই আট মাসে টিকা কেনা এবং বাজেট সহায়তা বাবদ ইতোমধ্যে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের মতো পেয়েছে বাংলাদেশ।
সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১২.৫ শতাংশ
এই আট মাসে আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ১২দশমিক ৫০ শতাংশ। এ সময়ে সরকার আসল ও সুদ বাবদ উন্নয়ন সহযোগীদের ১৩৩ কোটি ৫১ ডলার শোধ করেছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ১১৮ কোটি ৭৪ লাখ ডলার।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭১০ কোটি (৭.১ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ আসে বাংলাদেশে। ওই বছর ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পাওয়া গিয়েছিল।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসেছিল ৬৫৪ কোটি ডলার।