দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে উপজেলা পর্যায়েও আধুনিক প্রযুক্তির সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করতে উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরোনো দিনের চলচ্চিত্রগুলোকে সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি ডিজিটালাইজড করে দর্শকের সামনে আনারও তাগিদ দিয়েছেন সরকারপ্রধান।
এমনকি চলচ্চিত্রের উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার ফান্ড করে রাখার কথাও বলেছেন তিনি।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বুধবার সকালে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২০’ প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।
প্রধানমন্ত্রী সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারায় তার পক্ষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যদিও এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। আমাদের সিনেমাটা আসলে সেই অ্যানালগ সিস্টেমে থেকে গিয়েছিল, থেকে যাচ্ছে। সেটাকে আমি আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন করতে চাই।’
মাঝে উদ্যোগ নেয়া হলেও পরিস্থিতির কারণে তাতে ভাটা নামে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি আগেও যারা মালিক তাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাদের সহযোগিতা করব বলে আমি অফার দিয়েছিলাম। আসলে মাঝখানে একটু ভাটা পড়ে যাওয়ায় অনেকে উদ্যোগী ছিলেন না। এখন আমরা ১ হাজার কোটি টাকার একটি আলাদা ফান্ড তৈরি করে রেখেছি। আমি চাই আমাদের জেলা, উপজেলায় সব জায়গায় সিনেপ্লেক্স নির্মাণ হোক। যেখানে আধুনিক প্রযুক্তিতে চলচ্চিত্র দেখানো যায়।’
চলচ্চিত্রশিল্প একটা সময়ে বাধার মুখে পড়েছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘করোনার সময় অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন যেহেতু আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি, আমি চাই যে শিল্পটি গড়ে উঠুক।’
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা সুন্দর কমপ্লেক্স তৈরি করার প্রজেক্ট আমরা নিয়েছি। সেটার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। যদিও বেশ দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু এটা হয়েছে।’
চলচ্চিত্রশিল্পী, কলাকুশলীদের জন্য গঠন করা ট্রাস্ট ফান্ডে অনুদান দিতে বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
গণভবন থেকে যুক্ত হয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেন প্রধানমন্ত্রী, তার পক্ষে পুরস্কার হস্তান্তর করেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
তিনি বলেন, ‘শিল্পী-কলাকুশলী সবাই যাতে সুযোগ পায়, তার জন্য একটা ট্রাস্ট ফান্ড তৈরি করে দিয়েছি। আমরা সেখানকার সিড মানির ব্যবস্থাও করেছি। আমি মনে করি, আমাদের অনেক বিত্তবান আছেন, শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছেন, কেউ কেউ তো পুরস্কার পেলেন; আমি চাই, যারা বিত্তবান তারা এ ফান্ডে আরও বেশি করে টাকা রাখেন।’
এমন আহ্বান জানানোর কারণও ব্যাখ্যা করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘আমি নিজে দেখেছি, আমাদের বহু চিত্রশিল্পী বা চলচ্চিত্র শিল্পীরা বা অন্য সংস্কৃতিসেবীরা কিংবা আমাদের খেলাধুলায় সম্পৃক্ত যারা, সবাই যখন একটু বয়োবৃদ্ধ হয়ে যায়, অসুস্থ হয়ে যায়, সবার একটা করুণ অবস্থা হয়।
‘আমি যখন সরকারে থাকি বা বিরোধী দলে থাকি, আমি সব সময় চেষ্টা করি খোঁজখবর রাখার, সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি সহযোগিতা দিতে। তবে এই ট্রাস্ট ফান্ডটা আমি এ জন্য করেছি, যেন তাদের বিপদ-আপদে বা যখন বৃদ্ধ হয়ে যায়, তখন এই ট্রাস্ট ফান্ড থেকে চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা পেতে পারেন।
‘সে জন্য আমার একটা আহ্বান থাকবে, যারা বিত্তশালী তারা এই ফান্ডে টাকা রাখবেন বেশি করে। যাতে আমাদের কোনো শিল্পীরা যাতে কোনো কষ্ট না পায়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।’
পুরোনো চলচ্চিত্রগুলোকে ডিজিটালাইজড করে নতুন রূপে উপস্থাপন করা প্রয়োজন বলেও জানান সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেটা (চলচ্চিত্রগুলোকে ডিজিটালাইজড করা) আমরা সীমিতভাবে নিয়েছি। কিন্তু আমি মনে করি, এটা আরও নেয়া দরকার। কারণ আমাদের যত পুরোনো সিনেমা আছে, সেগুলোকে নতুন আঙ্গিকে নিয়ে আসতে হবে। ডিজিটালাইজড করে দিতে হবে, যেন সেগুলো মানুষের কাছে সহজে উপস্থাপন করা যায়।’
অভিনয়শিল্পীদের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাদের ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি জানি যে সুযোগটা খুব সীমিত। কিন্তু তার মধ্য দিয়েও প্রডাকশনগুলো এত সুন্দর হয়, যা সত্যি মুগ্ধ হয়ে যাই। যদিও আমি হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে পারি না।’
বিদেশ সফরে যাওয়ার সময় বিমানে বসে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে প্লেনে যখন যাই, তখন আমি সব সময় আমার দেশের সিনেমাগুলো দেখি। অনেক সময় অনেকে সিনেমা করে আমাকে দয়া করে একটা পেনড্রাইভে পাঠান বা কোনো কিছুতে পাঠান, সেটাও আমি দেখি। আমার ভালোই লাগে, আমাদের দেশের সিনেমাগুলো দেখতে।’
এ শিল্পে সম্পৃক্ত সবার প্রতি আহ্বান রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা, অর্জন, আমাদের গণমানুষের যে আত্মত্যাগ এবং আমাদের এগিয়ে চলার পথ, সেই পথটাও যেন মানুষের সামনে আরও ভালোভাবে উপস্থাপিত হয় এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ যেন সুন্দরভাবে এগিয়ে যেতে পারেন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বা নতুন প্রজন্ম, তারা যেন নিজের জীবনকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে সেভাবে আপনারা শিল্পগুলো তৈরি করবেন, মানুষের সামনে উপস্থাপন করবেন, সেটাই আমি চাচ্ছি।’
দেশের সংস্কৃতিকে আরও এগিয়ে নেয়ারও তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা বাঙালি, বাঙালি হিসেবে এটা আমার একটা স্বভাবজাত যে সংস্কৃতিকে আরও আপন করে, আরও উন্নত করে নেয়া। কাজেই বাঙালি মানে তো আমরা শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য এই নিয়েই তো আমাদের জাতীয় সত্তা। কাজেই এটা আরও বিকশিত হোক, এটাই আমি চাই।’
‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে’ এমন প্রত্যয় রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের এই শিল্পও আরও বিকশিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন তো আমরা ডিজিটাল সিস্টেম করে ফেলেছি সারা বাংলাদেশে। কাজেই শিল্পের বিকাশ ঘটার অনেক অনেক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের তরুণ সম্প্রদায়ের যারা এগিয়ে এসেছে এই সিনেমা শিল্পে, তাদের আমি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি, কারণ এরাই তো ভবিষ্যৎ।’
চলচ্চিত্রকে ‘জীবনের প্রতিচ্ছবি’ হিসেবে বর্ণনা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
তিনি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা দেখেছি বা আমরা যদি ইতিহাস ঘাঁটি চলচ্চিত্র আমাদের সমাজকে যেমন সংস্কার করতে পারে, সমাজ সংস্কারে এই চলচ্চিত্র বিরাট অবদান রাখতে পারে, যা মানুষের মনে দাগ কাটে। জীবনদর্শন- এটাই প্রকাশ পায় বা সময়কালীন বিভিন্ন ইতিহাসের ধারাটা জানা যায়। এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে অনেক বার্তা পৌঁছে দেয়া যায়।’
চলচ্চিত্রকে ‘ইতিহাসের বার্তাবাহক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেটা ইতিহাসকে ধরে রাখে। অনেক অজানাকে জানার সুযোগ করে দেয়। হারিয়ে যাওয়া ঘটনাকেও সামনে নিয়ে আসে, যা জীবনের সঙ্গে মিশে যায়। তা ছাড়া ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে, সমাজের অনেক অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা, দূর করতেও কিন্তু এই চলচ্চিত্র বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।’