যুদ্ধের মাস এলেই ইব্রাহিমের মনে পড়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দেয়া এক টাকা বকশিশের কথা। তাদের নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যার স্মৃতি ভুলতে পারেননি তিনি।
মেহেরপুর গাংনী উপজেলার বামন্দী ইউনিয়নের বামন্দী গ্রামে বসবাস ইব্রাহিমের। পেশায় চায়ের দোকানি।
নিউজবাংলাকে তিনি জানান ৫০ বছর আগের এক দুঃসহ স্মৃতির কথা। সেই স্মৃতি তাকে এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়।
১৯৭১ সালে সবে তেরো-চৌদ্দ বছরে পা দিয়েছেন ইব্রাহিম। পরিবার ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুনেছেন, এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী গড়ে তুলেছে অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখানে মুক্তিকামী নিরীহ মানুষকে ধরে এনে করা হচ্ছে নির্যাতন। আবার অনেককেই নির্যাতন শেষে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গ্রামজুড়ে। তবু তিনি বের হয়েছিলেন ঘরের বাইরে। এসেই পড়েন পাকিস্তানি মিলিটারির সামনে।
তিন পাকিস্তানি সেনা তাকে ধরে নিয়ে যায় বামন্দীর অস্থায়ী ক্যাম্পসংলগ্ন আখ ক্ষেতের কাছে। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করছিল আরও চার সেনা।
তারা ইব্রাহিমের হাতে একটা কোদাল ধরিয়ে নির্দেশ দিলেন মাটি খুঁড়তে। জীবনের ভয়ে হুকুম মেনে কাজ শুরু করেন তিনি। তিন ফুট গভীর করে গর্ত খোঁড়া হয়। এরপর সেই গর্তের সামনে এক বাঙালি যুবককে হাত-পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় ধরে আনা হয়। মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে করা হলো গুলি। নিমিষেই লুটিয়ে পড়েন সেই যুবক।
এবার পাকিস্তানি বাহিনী ইব্রাহিমকে নির্দেশ দেয় যুবকের লাশ সোজা করে গর্তের মধ্যে রাখতে এবং মাটি চাপা দিতে।
ইতোমধ্যে শিশু ইব্রাহিমের পুরো শরীর ভিজে গেছে রক্তে। মাটি চাপা দেয়ার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরাও হাত লাগিয়েছিল। মাটি কোনোমতে চাপা দেয়া শেষ হলে ইব্রাহিমের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিয়ে এ পাকিস্তানি সেনা সদস্য তার পকেটে এক টাকার একটি নোট গুঁজে দেয়। তারপর চলে যায়।
এটি ছিল ইব্রাহিমকে দেয়া বকশিশ।
সেই দিনের কষ্টের স্মৃতি ও বকশিশের এক টাকার কথা আজও ভুলতে পারেননি ৬৪ বছর বয়সী ইব্রাহিম। সেই ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত একবারও তিনি ফিরে দেখেননি সেই জায়গাটি।
২৫ বছর বয়সে গ্যাংগ্রিন হয়ে কাটা পড়ে ইব্রাহিমের একটি পা।
জানতে চাইলাম, বকশিশের সেই এক টাকা দিয়ে তিনি কী করেছিলন।
ইব্রাহিম বলেন, ‘আমি ভীত অবস্থায় বাড়িতে ফিরে রক্তমাখা সেই এক টাকার নোটটি পানি দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকাতে দি। তারপরে সেই টাকা নিয়ে খুচরা পয়সা করে অসহায় ব্যক্তিদের দান করে দি।’