দখলদারদের কবলে পড়ে মৃতপ্রায় বরিশালের লাখোটিয়া খাল খনন করে তা উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা। একটা সময় এই খাল থেকে জমিতে সেচ দেয়া হতো। এখন সেটি দখলের মুখে মৃতপ্রায়।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, উন্নয়ন কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে। কীভাবে খালটি ফিরিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, দখলদার উচ্ছেদ করা হলে খাল খননের উদ্যোগ নেয়া যাবে।
লাখোটিয়ার জমিদার রাজচন্দ্র রায় বরিশাল নগরীতে যাতায়াতের জন্য লাখোটিয়া থেকে বরিশাল মহাশ্মশান ঘাটের পোল পর্যন্ত খনন করেছিলেন খালটি। এটিকে যুক্ত করে দিয়েছিলেন শার্শী থেকে বাবুগঞ্জের সুগন্ধা নদীর সঙ্গে। এতে সুবিধা হয়েছিল দুই উপজেলার প্রায় ১০ সহস্রাধিক কৃষকের। মহাশ্মশান ঘাটের পোল থেকে মুখার্জি বাড়ির পোল পর্যন্ত দখলদারদের কবলে পড়ে খালটি এখন কৃষকের দুঃখে পরিণত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, সেচ কাজে ১০ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খালটির গুরুত্ব বিবেচনায় এনে ১৯৮৫ সালে বরিশাল ইরিগেশন প্রজেক্টের (বিআইপি) মাধ্যমে এটি পুনঃখনন করা হয়েছিল। আট বছর আগে এলজিইডির প্রকল্পের মাধ্যমে এটির একটি অংশ আবারও খনন করা হয়।
দখলদারদের কবলে পড়ে খালটি এখন মৃতপ্রায়। ছবি: নিউজবাংলা
ওই খনন করা অংশে পানিপ্রবাহ কিছুটা থাকলেও মুখার্জি বাড়ির পোল হয়ে মহাশ্মশান ঘাটের পোল পর্যন্ত পুরোটাই এখন স্থবির। এই অংশে একদিকে দখলদার, অন্যদিকে এলজিইডি বিভাগের নির্মিত অপরিকল্পিত কালভার্ট খালটির শ্বাসরোধ করেছে। এ ছাড়া বিসিকের কারখানার বর্জ্য পানিতে মিশে পচা দুর্গন্ধে এলাকা ভরিয়ে ফেলেছে।
ক্ষতিকর পানি রোধে আবেদশাহের মাজারের সামনে খালে বাঁধ দিয়ে তবেই বোরো ধানের আবাদ করছেন কৃষকরা। পানিপ্রবাহ সচল থাকলে খাল থেকে সহজেই পানি পাবার কথা ছিল। ৩ বছর ধরে বর্ষায় পানি নামার কোনো পথ না থাকায় আমন মৌসুমে ১০ ভাগের ১ ভাগ ফসলও ঘরে তুলতে পারেননি কৃষকরা।
শার্শী গ্রামের কৃষক জগলুল হায়দার বলেন, ‘আমনের মৌসুমে আমি ১ একর ৪০ শতাংশ জমিতে ধান লাগাইছিলাম। লাখোইট্টার খালে বর্ষার পানি জইমা একবার বীজতলা পইচা গেছে। হেইয়ার পর আবার বীজ কিইন্যা আইন্যা লাগাইছি। খালে পানি ওডে, কিন্তু নামতে পারে না। আমি কমছে কম ৬০ মণ ধান পাইতাম। ধান পাইছি মাত্র ৪ মণ। আর নাড়াকুডা হেয়াও গরুতে খাওয়ার মতো অবস্থায় নাই।’
এখানের আরেক কৃষক মুনসুর আলী বলেন, ‘তিন বছর ধইরা আমনে মাইর খাই। শার্শী স্লুইসগেট থেইক্যা মুখার্জিবাড়ীর পোল পর্যন্ত খাল কাডার পর বর্ষায় পানি ওডে ঠিকমতো। তয় নামতে পারে না। মুখার্জিবাড়ীর পোলের পর জেলখাল হইয়া ফরিয়াপট্টির মুখ পর্যন্ত খাল কাইড্যা পানি নামার ব্যবস্থা হরলে আমাগো ফসল মাইর খাইত না।
‘দুঃখও থাকত না। তিন বছরে আমনে মাইর খাইয়া ক্ষতি পোষাইতে সবাই উইড্যা পইরা বোরো ধান লাগাইতেছি। তয় প্রকৃতি উল্ডা অইলে যদি পানি জমে, তাইলে আর রক্ষা পামু না। কৃষিকাজই ছাইড়া দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাইকবে না।’
মুখার্জিবাড়ী পোল এলাকার বাসিন্দা আসলাম খান বলেন, ‘এখানে খালের প্রস্থ ২০ ফুটের ওপরে থাকলেও দুই দশক আগে ১০ ফুট কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। এতে করে খালটির পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে আবর্জনা জমে দখলদারদের যেন সুবিধা করে দেয়া হয়েছে। এমন অপরিকল্পিত কালভার্টের সংখ্যা রয়েছে পাঁচটি।
‘এ ছাড়া খালের পূর্বাংশে বসতবাড়ি, দোকানপাট নির্মাণ আর আবর্জনা ফেলায় শুকনা মৌসুমে খালের পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিসিক থেকে বিভিন্ন কারখানার বর্জ্যের সঙ্গে বাসাবাড়ির টয়লেটের বর্জ্য নালার সংযোগ এই খালে হওয়ায় বিষিয়ে ওঠা পরিবেশ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক আগ থেকেই।’
একসময় এই খাল থেকেই আশপাশের জমিতে সেচ দেয়া হতো। ছবি: নিউজবাংলা
ছত্তার সিকদার নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘একটা সময় দেখছি, এই খাল দিয়া বড় বড় নৌকা চলতে। বিয়াবাড়ির বর যাত্রীও আইত ট্রলারে কইরা। এহন তো কলার ভোর চলারও সুযোগ নাই। যে যেহান দিয়া পারছে খালটারে খাইছে। বর্ষায় পানি না বাইরাইতে পারলে খাল দিয়া তো পানি বাইরাইয়া কৃষিজমিতে যাইবেই। আর হেতে ক্ষতি যে হইবে, হেডাও স্বাভাবিক। মোরা চাই খালটা আগের মতো হউক।’
বরিশাল সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ফাহিমা হক বলেন, ‘লাখোটিয়ার খালটির জন্য কৃষকদের ফসলহানির কথা জেনেছি। এ কারণে অনেক জমি একফসলি হয়ে পড়েছে। এই খালের পানিপ্রবাহ ঠিক থাকলে রবি মৌসুমে যেমন ফলন হতো, তেমনি আমন ও বোরো মৌসুমে কৃষক ভালো ফলন পেত। এ জন্য আমরা উপজেলা উন্নয়ন কমিটির মাসিক সভায় খাল খননের কথা উত্থাপন করেছি।’
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা আছে খালটি খনন করার। তবে দখলদারদের উচ্ছেদ ছাড়া এটা বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে খালটি রক্ষায় দখলদারদের চিহ্নিত করে উচ্ছেদ করার পরই আমরা খাল খননে নামব।’
বরিশালের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেন, লাখোটিয়া খালটি কীভাবে পুনরুদ্ধার করে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করে কৃষকদের বাঁচানো যায়, সেই বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে।