সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট-বিআরটি। রাজধানীর সঙ্গে গাজীপুর ও বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতকে স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে নেয়া হয় এ প্রকল্প।
২০১২ সালে একনেক সভায় অনুমোদন পায় এটি। সে সময় রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের সময় অর্ধেকে নেমে আসার বাস্তবমুখী পদক্ষেপে স্বস্তি ফিরেছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। তবে মেগা প্রকল্পটি এখন মানুষের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।
প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে আধা ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগছে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। সমন্বয়হীনতা, একাধিকবার নকশা বদল, নতুন নতুন অবকাঠামো যোগ আর ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে প্রকল্পটি দিনের পর দিন ভোগান্তি বাড়িয়ে তুলছে বলে জানা গেছে।
চার বছর মেয়াদী প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়নি ৯ বছরেও। সবশেষ বাড়ানো মেয়াদ অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২২ সালে। তবে ধীরগতির কাজে এ বছরও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
প্রকল্পে জনভোগান্তি এতটাই চরমে উঠেছে যে প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশ বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি লাইন নির্মাণ প্রকল্প থেকেই সরে এসেছে সরকার।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আলোচিত প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। ২০১৮ সালের নভেম্বরে অনুমোদিত হয় সংশোধিত ডিপিপি। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের অধীনে মোট ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার বিআরটি লেন বাস্তবায়নে রয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান।
বিআরটি প্রকল্প শুরুর পর থেকে সড়কটিতে গাড়ির সারি আরও দীর্ঘ হচ্ছে। ছবি: নিউজবাংলা
এর মধ্যে ১৬ কিলোমিটার এ্যাট গ্রেড সড়ক নির্মাণের দায়িত্বে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, সাড়ে ৪ কিলোমিটার এলিভেটেড অংশ নির্মাণের দায়িত্বে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং বাস ডিপো। সংযোগ সড়ক ও হাটবাজার নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার এলিভেটেড অংশে এবং ৮টি র্যাম্পে মোট ১৬৩টি স্প্যান রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যে ৭৮টি স্প্যানে আই গর্ভার এবং ৮৫টি স্প্যান বক্স গার্ডার নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। প্রকল্পের নকশা ছিল বক্স গার্ডারের মাধ্যমে উড়াল সেতু নির্মাণ।
তবে নকশা পরিবর্তন করে এলিভেটেড অংশের নির্মাণ কার্যক্রমে বক্স গার্ডারের পরিবর্তে আই গার্ডার পদ্ধতি অনুসরণের প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ অংশের মধ্যে উত্তরা হাউসবিল্ডিং থেকে টঙ্গী চেরাগআলী মার্কেট পর্যন্ত ৬ লেন বিশিষ্ট এলিভেটেড সেতু নির্মাণ করা হবে। এই অংশে ছয়টি এলিভেটেড স্টেশন, ১০ লেন বিশিষ্ট টঙ্গী সেতুও নির্মাণ করা হবে বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে গত রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত টঙ্গী সেতু থেকে গাজীপুরা পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চার কিলোমিটার সড়কের বিআরটির নির্মাণকাজে দেখা যায় ধীর গতি আর যানজটের দীর্ঘ সারি।
প্রকল্প সূত্র, ট্রাফিক বিভাগ, পরিবহন সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এ পথে যানজটের কারণগুলো জানা যায়।
এসব সূত্রে জানা যায়, টঙ্গী সেতু হতে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত বিআরটির ১৮টি স্টেশনের নির্মাণ কাজ, মহাসড়কে রোড ডিভাইডার না থাকা, যত্রতত্র ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পার্কিং, মহাসড়কের দুই পাশ দখল করে অস্থায়ী বাজার ও ধীরগতির নির্মাণকাজের কারণে সরকারের মেগা প্রকল্পটি ভোগাচ্ছে।
প্রকল্প এলাকায় গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী সেতু পর্যন্ত সব সময় ধুলার রাজত্ব। ধুলার কারণে মহাসড়কের আশপাশের অনেক খাবার দোকানি তাদের দোকানগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন।
গাজীপুরা বাসস্ট্যান্ড এলাকার হোটেল মালিক আমির হোসেন জানান, বিআরটির নির্মাণকাজের কারণে সারাক্ষণ ধুলা উড়ে। সড়কের পাশে হোটেল হওয়ায় ধুলায় টেবিল, প্লেট ও গ্লাস মাখামাখি হয়ে যায়। এ কারণে এখন কাস্টমারও আসে না হোটেলে।
স্থানীয়রা জানান, সাধারণত এই ধরনের মেগা প্রকল্পে যেন পরিবেশ দূষণ না হয় সেজন্য আলাদা বাজেট রাখা হয়। প্রতিদিন কাজ শুরুর আগে ও সন্ধ্যায় পানি ছিঁটাতে হয়, নির্মাণ সামগ্রী ক্ষেত্র বিশেষে ঢেকে রাখারও নিয়ম রয়েছে। তবে এর কোনোটিই করা হচ্ছে না বিআরটি প্রকল্পে।
ঢাকার একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন কবির হোসেন। গত নয় বছর ধরে ভোগান্তির কথা মনে করে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এটি কোনো উন্নয়ন প্রকল্প না, সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেয়ার প্রকল্প। শুকনো মৌসুমে ধুলায়, বর্ষায় কাঁদামাটি ও খানাখন্দ, আর বছর জুড়ে যানজটের কষ্ট পোহাতে হচ্ছে এ পথের যাত্রীদের।’
সরেজমিনে দেখা যায়, টঙ্গী এলাকায় মহাসড়কের মধ্যে সাজিয়ে রাখা আছে গার্ডার, দাঁড়িয়ে আছে পিলার। পিলারের নিচে রাখা বালুর স্তুপ, কংক্রিট ও পাথর। সড়ক সংকুচিত হয়ে পড়ায় ধীরগতিতে এক লেনে চলছে গাড়ি। বিভিন্ন স্থানে উচু-নিচু সড়ক ও খানাখন্দের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনাও।
জানা যায়, গাজীপুর অংশে মহাসড়কের প্রশস্ততা ৬০ থেকে ৬৫ ফুট। কিন্তু বিআরটি প্রকল্পটির কাজ শুরুর পর সড়কটি সরু হয়ে গেছে।
এছাড়াও শৃঙ্খলা না থাকায় যত্রতত্র মহাসড়কে উঠে পড়ছে ইজিবাইক ও অটোরিকশা। সড়কের মাঝে রোড ডিভাইডার না থাকায় বিভিন্ন স্থানে উল্টোপথে গাড়ি ঢুকেও সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিআরটির নির্মাণকাজ চলছে ধীর গতিতে। ছবি: নিউজবাংলা
গাজীপুর থেকে সায়দাবাদগামী বলাকা পরিবহনের চালক কামাল মিয়া বলেন, ‘আগে প্রতিদিন তিন থেকে চারবার আপডাউন করতে পারতাম। এখন একবারের বেশি বড়জোর দুইবার আপডাউন করা যায়। যানজটের ভয়ে এখন অনেকেই ট্রেনে যাতায়ত করে।’
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘গাজীপুরে যানজটের অন্যতম কারণ বিআরটির নির্মাণকাজ। এ প্রকল্পের আওতায় ২৫টি স্টেশন নির্মাণ হবে, এর মধ্যে গাজীপুর অংশেই হবে ১৮টি। যেসব স্থানে স্টেশন হচ্ছে সেগুলোতে সড়ক সংকুচিত হয়েছে। এক লেনে গাড়ি চলাচল, রোড ডিভাইডার না থাকা ও অনেক জায়গাতে গাড়ি উল্টোপথে গিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে।’
টঙ্গী এলাকার যানজট পরিস্থিতির বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, উত্তরা থেকে ফ্লাইওভারের গাড়িগুলো টঙ্গীর বাটা গেট ও আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামের সামনে এসে নামবে। এ জন্য সেখানে একটি লুপ তৈরি করা হচ্ছে। এ কারণেও যান চলাচলে ধীরগতি।
ট্রাফিকের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘টঙ্গী-কালিগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক দিয়ে সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটের গাড়ি চলাচল করে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের যানজট এড়াতে জয়দেবপুরের যাত্রীরা স্টেশন রোড হয়ে বনমালা ও নিমতলি সড়ক দিয়ে যাতায়ত করে।
‘সড়কটিতে যে পরিমান গাড়ি চলাচল করে, তার তুলনায় বেশ সরু। এছাড়া শহরের ভেতর বেশ কয়েকটি রেলক্রসিং রয়েছে। দিনে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ বার রেলক্রসিংয়ে গাড়ি আটকে থাকে বলে ওইসব এলাকায় যানজট লেগেই থাকে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের অন্য জেলাগুলোর চেয়ে গাজীপুরের বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে ট্রাফিক ম্যানেজম্যান্ট করা খুবই কষ্টকর। এখানে শিল্প কলকারখানায় প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক রয়েছে। তাদের চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট কোনো গাড়ি নেই। ইজিবাইক ও অটোরিকশাই তাদের একমাত্র বাহন।
‘এখানে চাইলেই আমরা অনেক কিছু করতে পারছি না। স্থানীয় সংসদ সদস্য, মেয়র, জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন সম্মিলিতভাবে কাজ করলে এটি সমাধান করা যাবে।’
বিআরটির কাজের অগ্রগতির বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক (সেতু বিভাগ) মহিরুল ইসলাম খান বলেন, ‘মার্চের মধ্যেই প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ শেষ হবে। প্রতিদিনই সড়কের কোনো না কোনো অংশে কার্পেটিংয়ের কাজ হচ্ছে।
‘আশা করি, বর্ষার আগেই প্রকল্পের নিচের সড়কের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে। তখন আর যানজটের ভোগান্তি থাকবে না। তবে ফ্লাইওভারসহ বাকি কাজগুলো শেষ হতে আরও সময় লাগবে।’