ভোজ্যতেলের বাড়ন্ত বাজার আপাতত ঠান্ডা হলো ভ্যাট প্রত্যাহারে। সেই সঙ্গে কিছুটা কমানো হয়েছে দর।
তবে সরকার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিলে পর দিন থেকেই বাজারে নতুন দামে বিক্রির যে ঘটনা দেখা যায়, কমানোর সিদ্ধান্তে সেটি দেখা গেল না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ১৬৮ টাকা লিটারের জায়গায় ১৬০ টাকা লিটার ধরে যে তেল মিল থেকে ছাড়া হচ্ছে, সেটি এখনও খুচরা পর্যায়ে দেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
কোম্পানিগুলো বলছে, নতুন দামে নিজ নিজ পরিবেশকদের কাছে তেল দিচ্ছে আমদানিকারক, পরিশোধন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো। তবে স্বল্প প্রস্তুতির কারণে সরবরাহের ছিল কম।
আবার মিল থেকে যেটুকুই ছাড়া হয়েছে সেটিও পৌঁছেনি পাইকারি পর্যায় হয়ে খুচরা পর্যায়ে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে। তেলের দাম আরও বাড়তে পারে- এমনটি ভেবে যারা মজুত করেছিলেন, তারা সেই তেল বিক্রি করে নতুন তেল কিনবেন।
তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পর কেন খুচরা বাজারে প্রভাব পড়তে দেরি না হলেও এখন কেন এমনটি হবে- এমন প্রশ্নের জবাব না খুচরা ব্যবসায়ী, না পাইকারি ব্যবসায়ী, না উৎপাদক-পরিবেশক- কারও কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
করোনা পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে সারা বিশ্বেই পণ্যমূল্য বাড়ছে ব্যাপক হারে। এর প্রভাব পড়েছে দেশেও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা সয়াবিন তেল নিয়ে।
গত বছর রোজার সময় দাম ছিল লিটারে ১৩৪ টাকা। সেটি গত ৬ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ হয় ১৬৮ টাকা। মার্চ থেকে আরও ১২ টাকা বাড়িয়ে লিটারে ১৮০ টাকা করতে চেয়েছিল ব্যবসায়ীরা।
সরকার এবার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার পর বাজারে সরবরাহে দেখা দেয় ঘাটতি। চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমন্বয়হীনতার মধ্যে সরকার তেলের উৎপাদন ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়।
তেলের সিংহভাগ আমদানি করে পরিশোধন করা হয়। আর উৎপাদন ও বিক্রয় পর্যায়ে পুরোটা আর আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ রেখে বাকি সব ভ্যাট প্রত্যাহার করার পর খরচ ও মুনাফা হিসাব করে লিটারে দাম আট টাকা কমানো হয়েছে।
নতুন দাম সোমবার থেকেই কার্যকর, সেটি জানিয়ে দেয়া হয় আগের দিনই। তবে এই দাম মিল গেটে হবে-এটাও বলা ছিল। মিলগেট থেকে পাইকারিতে, পরে খুচরায় প্রভাব পড়তে চার থেকে পাঁচ দিন লেগে যাবে।
তবে গত ৬ ফেব্রুয়ারি যখন তেলের দাম লিটারে আট টাকা বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়, তখন খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়তে এই চার/পাঁচ দিন লাগেনি। পরের দিন না, ওই সন্ধ্যা থেকেই বেড়ে যায় দাম।
বাণিজ্যিকভাবে দেশে এখন পর্যন্ত খোলা সয়াবিন ও পামতেলের চাহিদাই বেশি। অন্যদিকে বাসাবাড়িতে বেশি ব্যবহার হয় বোতলজাত সয়াবিন। এ বোতলজাত সয়াবিনের বড় অংশই সরবরাহ করছে গুটিকয়েক কোম্পানি।
এদের মধ্যে তীর ব্র্র্যান্ডের তেল বাজারজাত করছে সিটি গ্রুপ, ফ্রেশ ব্র্যান্ডের মেঘনা গ্রুপ, রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড, পুষ্টি ব্র্যান্ডের টিকে গ্রুপ ও বসুন্ধরা ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন বাজারজাত করছে বুসন্ধরা গ্রুপ।
এর বাইরে এস আলম গ্রুপের মোরগ, এস এ গ্রুপের মুসকান, নূরজাহান গ্রুপের নূরজাহান, ইলিয়াস ব্র্যাদার্সের দাদা, মোস্তফা ভেজিটেবলের মোস্তফা, রুবাইয়া ভেজিটেবলের রুবাইয়া ব্র্যান্ডের সয়াবিন বাজারজাত হচ্ছে।
এস আলম গ্রুপের সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক কাজী সালাহউদ্দিন আহাম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রোববার বিকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দাম কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন দাম মিল পর্যায়ে কার্যকরের বিষয়ে কোম্পানির নির্দেশনা গতকালই মিলের উৎপাদন বিভাগে চলে গেছে। স্বল্প প্রস্তুতির মধ্যেও কারখানা থেকে সোমবারই নতুন দামে মাল ছাড়া শুরু হয়েছে।’
দাম কমালে বাজারে প্রভাব পড়াতে দেরির কারণ উঠে এলো তার বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘হ্রাসকৃত দামের খোলা সয়াবিন আমরা সোমবারই তালিকাভূক্ত ডিলারদের কাছে সরবরাহ দিয়েছি। তারা পাইকারদের কাছে দেবে এবং তারপর খুচরা পর্যায়ে যাবে। তাই নতুন দাম ভোক্তা লেভেলে পৌঁছাতে হয়ত দুই-একদিন সময় লাগবে।
‘বৈশ্বিক কারণে সম্প্রতি দেশে মাসাধিককাল দেশে ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা গেছে। তাই দাম বাড়তে পারে ধারণা করে অনেকে আগে থেকেই কিছু পরিমাণ তেল মজুদ করেছিল। এখন তারা সেই মজুত শেষ না করে তো নতুন মাল নেবে না।’
মৌলভীবাজার ভোজ্যতেল পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, ‘দাম বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে বাজারে প্রভাব পড়ে এবং কমলে একটু দেরিতে পড়ে কথাটি আংশিক সত্য। কারণ দাম যখন বাড়তি থাকে তখন বাজারপর্যায়ে চাহিদার কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে এবং এতে বিক্রি কম হয়। ফলে তখন বিভিন্নস্তরে আগের সরবরাহকৃত মালের মজুত তৈরি হয়। তখন ব্যবসায়ীদের উভয়সংকটে পড়তে হয়।’
তিনি বলেন, ‘যখন দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে তখন কম দামে কেনা খোলা সয়াবিনের আগের মজুত বাড়তি দামে বিক্রির সুযোগ থাকলেও বোতলজাত সয়াবিনের ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। আবার দাম কমার ঘোষণা আসলে আগের মজুতে বোতলের গায়ে বাড়তি দাম উল্লেখ থাকলে সেটিও কমে বিক্রির সুযোগ নেই।’
তাই এমন প্রেক্ষাপটে বাজারে যে তেল আছে তার মজুত না ফুরানো পর্যন্ত তেলের দাম কমার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।
সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘আমরা নতুন দামে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ শুরু করেছি। প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার টন তেল আমরা মিল থেকে সরবরাহ দেই। সোমবার আমরা সেই স্বাভাবিক সরবরাহ দিতে পারিনি। কারণ সরবরাহকৃত বোতলজাত সয়াবিনের দাম সম্বলিত লেভেল প্রিন্টিংয়ের বিষয় আছে। আজও বোতলের গায়ে নতুন দামের লেভেল প্রিন্টিং হচ্ছে। এটা চলতে থাকবে। দুই-একদিনের মধ্যে আমরা সরবরাহের সবটুকুই নতুন দামে দিতে পারব।’
টিকে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতাহার তসলিম বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পরই আমরা মিলপর্যায়ে বোতলজাত সয়াবিনের লেভেলে নতুন দাম প্রিন্টিং করার নির্দেশনা পাঠিয়েছি। স্বল্প সময়ের মধ্যে যা উৎপাদন হয়েছে আজ তার ডেলিভারি হয়েছে। তবে মঙ্গলবার থেকে পুরোদমে ডেলিভারি শুরু হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও আমদানি) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘কোম্পানিগুলো মিল থেকে নতুন দামে স্বল্প পরিসরে সয়াবিন বাজারজাত শুরু করেছে। তবে এখানে লাখ লাখ বোতলের লেবেলে নতুন দাম প্রিন্টিং করার বিষয় রয়েছে। এর জন্য প্রস্তুতি ও সময়ের ব্যাপার রয়েছে।
‘গতকাল নতুন দামের প্রিন্ট শুরু করেছে। দুই-একদিনের মধ্যেই মিল পর্যায় থেকে এই দামের সয়াবিনের স্বাভাাবিক সরবরাহ আমরা দেখব।’
বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বাজার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসেই চাহিদা প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, স্থানীয় উৎপাদন প্রায় দুই লাখ টন। বাকি প্রায় ১৮ লাখ টন আমদানি করে ভোক্তার চাহিদা পূরণ করতে হয়।