বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কিশোরীকে প্রকাশ্যে পেটানোর আসামিরা ১ দিনেই মুক্ত

  •    
  • ২১ মার্চ, ২০২২ ১৮:৪৩

ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর গত শুক্রবার কিশোরীর বাবা যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন। এর পরপরই পুলিশ অভিযুক্ত ইউপি সদস্য আনিচুর রহমানসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। তবে পরদিন শনিবার রাতেই আনিচুর ও তার দুই সহযোগী জামিনে মুক্তি পান।

যশোরে কিশোরীকে বেঁধে পেটানোর মামলার প্রধান আসামি ইউপি সদস্য আনিচুর রহমান ও তার দুই সহযোগী গ্রেপ্তার হওয়ার এক দিন পরেই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এর জন্য মামলার দুর্বল ধারাকে দায়ী করছেন স্থানীয় আইনজীবীরা।

অভিযুক্ত ইউপি সদস্য জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে কিশোরীর পরিবারকে হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সদর উপজেলার চূড়ামনকাটি ইউনিয়নের আব্দুলপুর গ্রামে গত ১৫ মার্চ ওই কিশোরীকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পিটুনির ঘটনার দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ১ মিনিট ২৯ সেকেন্ড এবং ৪৪ সেকেন্ডের দুটি ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি দোকানে অর্ধশতাধিক মানুষের সামনে কিশোরীকে এলোপাতাড়ি জুতাপেটা করছেন ইউপি সদস্য আনিচুর রহমান। লাঠি দিয়েও পেটানো হয় কিশোরীকে। কয়েক যুবক তাকে লাথিও দেন।

ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর গত শুক্রবার কিশোরীর বাবা যশোর কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেন। এর পরপরই পুলিশ অভিযুক্ত ইউপি সদস্য আনিচুর রহমানসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। বাকি তিনজন হলেন আব্দুলপুরের আব্দুর রহমান ভুট্টো, আব্দুল আলীম ও আইয়ুব আলী।

তবে পরদিন শনিবার রাতেই আনিচুর ও তার দুই সহযোগী আব্দুল আলীম ও আইয়ুব আলী জামিনে মুক্তি পান। আরেক আসামি ভুট্টোর বিরুদ্ধে চুরির মামলা থাকায় তাকে কারাগারে পাঠান বিচারক।

তিনজনের জামিনের বিষয়টি নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন যশোর সদর কোর্টের জিআরও মুজিবুর রহমান এবং হাজতখানার ইনচার্জ এটিএসআই সন্তোষ কুমার রায়।

কিশোরীকে নির্যাতনের মামলায় গ্রেপ্তার আনিচুরসহ (লাল গেঞ্জি পরা) চার আসামি। ছবি: নিউজবাংলা

জেলার আইনজীবীরা মনে করছেন, স্পর্শকাতর মামলা হলেও দুর্বল ধারার কারণে ইউপি সদস্য ও অন্য দুই আসামি জামিন পেয়েছেন।

যশোর নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি সেতারা খাতুন নিউজবাংলাকে জানান, জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মঞ্জুরুল ইসলাম শনিবার ৩ আসামিকে জামিন দেন। অপর আসামির বিরুদ্ধে আগে থেকে চুরির মামলা থাকায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

এ ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় মামলা হলে আসামিরা জামিন পেতেন না বলে মনে করছেন সেতারা খাতুন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধের সংজ্ঞা ও দণ্ডের উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে তাহার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তাহার শরীরের যেকোনো অঙ্গ বা কোনো বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করেন তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন তিন বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’

এর পরিবর্তে কিশোরীকে নির্যাতন মামলায় মোট দণ্ডবিধির পাঁচটি ধারা রয়েছে। এগুলো হলো ১৪৩, ৩২৩, ৩৪১, ৩৫৪, ৩৭৯, ৫০৬ ধারা। এসব ধারার সবই জামিনযোগ্য অপরাধসংক্রান্ত।

ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বেআইনি সমাবেশের সদস্য হবে, সে ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’

মামলা রেকর্ড করার সময় ৩৫৪ ধারা না দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারা দেয়া হলে আসামিদের কেউ জামিন পেতেন না। সবাই কারাগারে যেতেন।

‘ইচ্ছাকৃত আঘাতদানের শাস্তি’র প্রসঙ্গ রয়েছে ৩২৩ ধারায়। এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি, ধারা-৩৩৪ এ ব্যবস্থিত ক্ষেত্র ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত দান করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ এক বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে- যার পরিমাণ এক হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’

‘অবৈধ বাধাদানের শাস্তি’র প্রসঙ্গ রয়েছে ৩৪১ ধারায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ, কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে বাধাদান করে, তাহলে ওই ব্যক্তি বিনাশ্রম কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ এক মাস পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে- যার পরিমাণ পাঁচশত টাকা পর্যন্ত হতে পারে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’

‘শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে কোনো নারীর ওপর আক্রমণ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ’-এর শাস্তি বর্ণিত আছে ৩৫৪ ধারায়। এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি, কোনো স্ত্রীলোকের শ্লীলতাহানির অভিপ্রায়ে বা সে তদ্বারা তার শ্লীলতাহানি হতে পারে জেনে তাকে আক্রমণ করে বা তৎপ্রতি অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে, তাহলে সে ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ দুই বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।’

৩৭৯ ধারায় চুরির কথা আছে। এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি চুরি করে তাহলে সে ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ তিন বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।’

আর ‘অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের শাস্তি’র প্রসঙ্গ রয়েছে ৫০৬ ধারায়। এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের অপরাধ সংঘটন করে, তাহলে সে ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ দুই বৎসর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।’

কিশোরীর ওপর নির্মম সহিংসতার ঘটনার মামলায় এ ধরনের দুর্বল ও কম শাস্তির ধারা যুক্ত করায় বিস্মিত যশোরের স্থানীয় মানুষ।

জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী ফরিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলায় শ্লীলতাহানির ধারা দেয়া হয়েছে ৩৫৪। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারা দেয়া যেত, যা জামিন অযোগ্য।

আমার মেয়েকে এমনভাবে পেটানো হয়েছে, তার সমস্ত শরীরে কালো দাগ হয়ে গেছে। সে এখনও রাতে ভয়ে কেঁপে উঠছে।

‘মামলা রেকর্ড করার সময় ৩৫৪ ধারা না দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারা দেয়া হলে আসামিদের কেউ জামিন পেতেন না। সবাই কারাগারে যেতেন।’

অভিযোগ উঠেছে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরই অভিযুক্ত ইউপি সদস্য আনিচুর ও তার দুই সহযোগী এলাকায় ফিরে বাদীপক্ষকে হুমকি দিচ্ছেন। কিশোরীর মা নিউজবাংলার কাছে এ অভিযোগ করেন।

নির্যাতিত কিশোরী এখনও যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সে নিউজবাংলাকে বলে, ‘দূর সম্পর্কের এক কাজিনের সঙ্গে একই ইউনিয়নের এনায়েতপুরে ওয়াজ মাহফিলে গিয়েছিলাম। এরপর মোটরসাইকেলে করে ফেরার পথে আমার সঙ্গে থাকা ছেলেটার সঙ্গে খারাপ সম্পর্কের অপবাদ দিয়ে মেম্বার আনিচুর রহমান সবার সামনে আমাকে জুতা ও লাঠিপেটা করে। বারবার আকুতি জানালেও তিনিসহ অন্যরা আমাকে ছাড়েননি।’

সঙ্গী ছেলেটির কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয় বলেও অভিযোগ করেন ওই কিশোরী।

ওই কিশোরীর মা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মেয়েকে এমনভাবে পেটানো হয়েছে, তার সমস্ত শরীরে কালো দাগ হয়ে গেছে। সে এখনও রাতে ভয়ে কেঁপে উঠছে। আমার মেয়ের সঙ্গে যা হয়েছে তার বিচার চাই। আনিচুর মেম্বার এখন আমাদের হুমকি দিচ্ছেন।’

তবে জামিনে মুক্তি পাওয়া ইউপি সদস্য আনিচুর রহমান হুমকি দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা। আমাকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করার জন্য একটি মহল এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যশোর কোতোয়ালি থানার এসআই সালাউদ্দিন খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি চাঞ্চল্যকর। আমি সব আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা অপরাধের কথা শিকার করেছেন। তাদের দাবি, অনৈতিক কাজের অভিযোগে মেয়েটিকে মারধর করা হয়।’

প্রধান অভিযুক্তসহ তিনজনের জামিন পাওয়ার বিষয়টি রোববার রাতে ‘লোক মারফত’ জেনেছেন বলে দাবি করেন এসআই সালাউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘জানতে পেরেছি ইউপি সদস্যসহ তিনজনের জামিন হয়েছে। এতে মামলার তদন্তে বিঘ্ন ঘটতে পারে।’

নারী নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় মামলা না দেয়ার কারণ জানতে চাইলে সালাউদ্দিন বলেন, ‘ওই ধারায় মামলা হয় শ্লীলতাহানি হলে। কিন্তু মেয়েটিকে মারা হয়েছে বলে ১০ ধারায় মামলা হয়নি। মারপিটের মামলা করা হয়েছে।’

বিষয়টি নিয়ে জানতে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি প্রশ্ন শুনেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

এ বিভাগের আরো খবর