বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-সিজিএস-এর তত্ত্বাবধানে করা এক গবেষণায় ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ৭১ জনকে গুমের তথ্য উঠে এসেছে। এদের মধ্যে ২৩ জন ফিরে এলেও তারা নিখোঁজ থাকা অবস্থায় কোথায় কেমন ছিলেন, তা নিয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
সোমবার সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় ‘কোথায় আছেন তারা? বাংলাদেশে গুমের ঘটনা’ বিষয়ে ওয়েবিনারে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
সংগঠনটি জানিয়েছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ঘেঁটে ২০১৯ সালে ৩১টি, ২০২০ সালে ১৬টি এবং পরের বছর ২৪টি ‘গুমের’ ঘটনা পেয়েছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইসড অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে হয়েছে এই গবেষণা। তিনি সিজিএসের উপদেষ্টামণ্ডলীরও সদস্য।
তিনি জানান, এই ৭১ ব্যক্তির মধ্যে ৬৫ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ২৩ জন ফিরে এসেছেন, ২২ জনকে পরে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে রাখা হয়েছে, ১৬ জন নিখোঁজ আর ৫ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে।
যারা ফিরেছেন তারা গবেষক দলের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বলেও জানান আলী রিয়াজ। বলেন, ‘সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গুমের ঘটনা স্বীকার করে না। তবে জাতিসংঘের কমিটি ৭৬ জনের তথ্য চাওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিবারের ওপর চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।’
ওয়েবিনারে জানানো হয়, যে ৭১ জনকে গুমের অভিযোগ উঠেছে, তাদের মধ্যে ১১ জন করে আছেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী, ৮ জন শিক্ষার্থী, ইমাম, খতিব ও ধর্মীয় প্রচারক ৫ জন, ৩ জন সাংবাদিক, ২ জন করে আছেন বেসরকারি কর্মচারী, গাড়িচালক ও জুট মিলের শ্রমিক, একজন করে আছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, চলচ্চিত্র পরিচালক, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও মাদ্রাসাশিক্ষক আছেন একজন করে।
দেশের ১৮টি জেলায় এই গুমের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬টি ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮টি ঘটেছে চট্টগ্রামে।
ওয়েবিনারে বলা হয়, এই ৭১টি ‘গুমের’ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ২১টি অভিযোগ আছে র্যাবের বিরুদ্ধে, গোয়েন্দা পুলিশের বিরুদ্ধে আছে ১৬টি, পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আছে ৬টি করে, ঢাকা মহানগর পুলিশ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডি ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে আছে ১টি করে। বাকি ১৯টি ঘটনা অজ্ঞাত।
আলী রিয়াজ বলেন, ‘গুম বাংলাদেশে সব আমলেই ছিল। তবে ২০১০ সাল পর্যন্ত গুমের ঘটনা নিয়মিত ও ব্যাপক হয়ে ওঠেনি। সময়ের সঙ্গে সংখ্যাটি বেড়েছে। ঘটনার পরিধি প্রসারিত হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ শিকার হয়েছেন।’
ওয়েবিনারে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য নুর খান বলেন, ‘দেশের মধ্যে এমন কিছু জায়গা আছে যা গোপন কারাগারের মতো।’
গুম হওয়ার পর যারা ফিরে এসেছেন, তাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক মানুষ তথ্য দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কখনও গান বাজানো হয়েছে, যাতে ভেতরের আওয়াজ বাইরে না যায়। তদন্তের মাধ্যমে সেই জায়গা খুঁজে বের করতে হবে।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অনেক মানুষ গুমের শিকার হতে পারেন বলেও শঙ্কার কথা বলেন তিনি।
পরিবেশ আইনজীবী সমিতি-বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কারা ধরে নিয়ে যায় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। কেন তারা ধরে নিয়ে যায় এটা দেখতে হলে এই প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক বলতে হবে। বিরুদ্ধ মত যাতে প্রকাশ না পায় সে জন্যই আসলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।...ভীতির আবহ ছড়িয়ে দিতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নগ্নভাবে ব্যবহার করা হয়।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের বন্ধু হতে গিয়ে আমাদের শত্রু হইয়েন না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল গুমকে ‘স্বতন্ত্র অপরাধ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানান।
র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে গুমের ঘটনা কমে গেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘ইলেকশনের আগে আবার গুম শুরু হবে।’