মাথার ভেতরে মগজের সুরক্ষায় খুলির প্রয়োজনীয়তা আমরা সবাই জানি। তবে কেবল আঘাত থেকে রক্ষা নয়, মস্তিষ্কে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাপনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে খুলির।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অনেকটা অগোচরেই এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা এতদিন বহাল ছিল। মাত্র বছর চারেক আগে প্রথম রহস্য ভেদ করেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, মগজের সঙ্গে খুলির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষায় আছে অসংখ্য সরু টানেল। এই টানেল দিয়ে খুলির অস্থিমজ্জা থেকে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মগজে পরিবাহিত হয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের একটি দল ২০১৮ সালে প্রথম এসব টানেলের খোঁজ পান। প্রথমে ইঁদুরের ওপর এবং মানুষের খুলি নিয়ে চলে গবেষণা। দেখা গেছে, মূলত এসব সরু টানেলের মাধ্যমেই মাথার খুলির অস্থিমজ্জার সঙ্গে মস্তিষ্কের সরাসরি সংযোগ রক্ষা হয়।
মস্তিষ্কে কোনো ক্ষতি ঘটামাত্র খুলির মজ্জা থেকে প্রতিরোধী কোষগুলো দ্রুততম সময়ে সুনির্দিষ্ট অংশে পৌঁছাতে এসব টানেল ব্যবহার করে। এর আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, স্ট্রোক, আঘাত বা মস্তিষ্কের অন্য কোনো ব্যাধির ক্ষেত্রে তৈরি হওয়া প্রদাহ মোকাবিলায় শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে রোগপ্রতিরোধী কোষ মাথায় পৌঁছায়।
২০১৮ সালের ওই গবেষণায় একেবারেই স্বতন্ত্র ও শর্টকাট পথের খোঁজ পান বিজ্ঞানীরা। তারা দেখার চেষ্টা করেছিলেন স্ট্রোক বা মেনিনজাইটিসের পরে প্রতিরোধী কোষগুলো মূলত দেহের কোথা থেকে মস্তিষ্কে পরিবাহিত হয়। প্রাথমিক কিছু ধারণা থেকে পরীক্ষার জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল মাথার খুলি এবং পায়ের হাড় টিবিয়াকে।
এই দলটি মস্তিষ্কে কোনো জটিলতার ক্ষেত্রে প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখানো নিউট্রোফিল নামের প্রতিরোধী কোষগুলোকে অনুসরণের কৌশল বেছে নেয়। এ ক্ষেত্রে সেল ট্র্যাকার হিসেবে কাজ করে এমন রঞ্জক যুক্ত করা হয় কোষের সঙ্গে।
শুরুতে ইঁদুরের খুলি ও টিবিয়ার মজ্জায় এই রঞ্জকযুক্ত নিউট্রোফিল প্রবেশ করান বিজ্ঞানীরা। লাল রঞ্জকের নিউট্রোফিল প্রবেশ করানো হয় মাথার খুলিতে এবং সবুজ রংয়ের কোষ টিবিয়াতে সরবরাহ করা হয়।
কোষগুলো অস্থিমজ্জায় খাপ খাইয়ে নেয়ার পর বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে কিছু ইঁদুরকে স্ট্রোকে এবং বাকিদের মেনিনজাইটিসসহ তীব্র প্রদাহের কয়েকটি রোগে আক্রান্ত করেন।
দেখা গেছে, স্ট্রোক বা মেনিনজাইটিসের মতো জটিলতার ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে প্রদাহ নিরসনে বেশি উপস্থিতি রয়েছে মাথার খুলির নিউনিউট্রোফিলের। তবে প্রশ্ন হলো, এই নিউনিউট্রোফিল খুলি থেকে কীভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মগজে পৌঁছে গেল?
বোস্টনের হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল এবং ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ম্যাথিয়াস নারেনডর্ফ এখন এই প্রশ্নের উত্তর জানেন। নারেনডর্ফ বলেন, ‘আমরা খুব সাবধানে মাথার খুলি পরীক্ষা করেছি। সমস্ত দিক থেকে দেখেছি। খুলি থেকে কীভাবে নিউট্রোফিল মস্তিষ্কে গেল তা বের করার চেষ্টা করেছি।
‘অপ্রত্যাশিতভাবে, আমরা খুলিতে অতি ক্ষুদ্র কিছু চ্যানেল আবিষ্কার করেছি যেগুলো মস্তিষ্কের বাইরের আস্তরণের সঙ্গে সরাসরি মজ্জাকে যুক্ত করে।’
এসব চ্যানেল বা টানেল খুলির মজ্জাকে মগজের প্রতিরক্ষামূলক ঝিল্লি ডুরার সঙ্গে যুক্ত করে। স্ট্রোকের মতো পরিস্থিতিতে এসব টানেল দিয়ে নিউট্রোফিল মস্তিষ্কে পরিবাহিত হয়।
বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের পাশাপাশি মানব খুলিতেও এসব টানেলের সন্ধান পেয়েছেন। এজন্য অস্ত্রোপচারের পর পাওয়া মানুষের মাথার খুলির টুকরো ব্যাপক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, মানুষের খুলিতে থাকা টানেলের ব্যাস ইঁদুরের খুলির চেয়ে পাঁচ গুণ বড়।
বিষয়টি নিয়ে ২০১৮ সালের পরেও গবেষণা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গত বছর পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া গেছে, মাথায় প্রদাহের ক্ষেত্রে প্রাথমিক প্রতিরোধী কোষের প্রায় সবটাই আসে খুলির অস্থিমজ্জা থেকে। দেহের অন্যান্য অংশ থেকে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে আসা কোষের সংখ্যা বলতে গেলে নগণ্য।
বিজ্ঞানীদের দলটির আশা, এই আবিষ্কার মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এমনকি এটি মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের মতো অবস্থা বুঝতেও সাহায্য করতে পারে, যেখানে রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা নিজেই মস্তিষ্ককে আক্রমণ করে।