এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গত এক যুগে দেশ অনেক এগিয়েছে। তবে লক্ষ্য অনেক দূর।
সোমবার পটুয়াখালীর পায়রায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উদ্বোধন করে তিনি এ কথা বলেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ১৩তম দেশ হিসেবে ‘আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি’ ক্লাবে নিজের নাম লেখাল বাংলাদেশ।
এই কেন্দ্রটি থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে অবশ্য আরও আগে থেকে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় পরীক্ষামূলক উৎপাদন।
এখানে মোট দুটি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে একটি ইউনিট পুরোপুরি বসিয়ে রাখতে হচ্ছে সঞ্চালন লাইন তৈরিতে বিলম্বের কারণে। আগামী ডিসেম্বরে সেই লাইন তৈরি হয়ে যাবে বলে জানানো হয়েছে, তখন পুরোদমে পায়রার সুফল ভোগ করবে দেশের মানুষ।
বিশাল এই স্থাপনাটিকে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, মুজিববর্ষ ও ঈদের উপহার হিসেবেও বর্ণনা করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুজিববর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং সামনে রোজা ও ঈদ। এই রোজা-ঈদ সবকিছু সামনে রেখে এই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র আপনাদেরকে উপহার দিয়ে গেলাম।’
খুনি আর যুদ্ধাপরাধীরা আর কখনও এ দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘মানুষ আজকে নিজেই জেগেছে, উঠে দাঁড়িয়েছে এবং এগিয়ে যাবে। এগিয়ে যাব আমরা ভবিষ্যতের দিকে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সুন্দর জীবন পায়, উন্নত জীবন পায়। সুন্দরভাবে দেশের মানুষ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলতে পারে।
‘সেইভাবে আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলব এবং গড়ে তুলছি। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি, সামনে আরও অনেক পথ আমাদের যেতে হবে। ইনশাল্লাহ এই চলার গতি আর কেউ থামাতে পারবে না।’
গত ১৩ বছর সরকারের ধারাবাহিকতা ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকায় দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করা গেছে বলেও মনে করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘এই ১৩ বছর একটানা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অব্যাহত রয়েছে। এর মাঝে ঝড়ঝঞ্ঝা অনেক এসেছে, বাধা অনেক এসেছে। কিন্তু সে বাধা আমরা অতিক্রম করেছি, অতিক্রম করে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে পেরেছি বলেই আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বল্পোন্নত দেশ হিসেব গড়ে তুলে রেখে গিয়েছিলেন, আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।’
অতীতে দেশের বিদ্যুৎ খাতের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ সব সময় সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশ সব সময় পিছিয়ে যাচ্ছিল। ২১ বছর আর এরপর ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত যারা সরকারে ছিল, আসলে এ দেশকে এগিয়ে নেয়ার কোনো আন্তরিকতা তাদের ছিল না। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য এ দেশের মানুষের।’
বিদ্যুৎ খাতে বদলে যাওয়ার বাংলাদেশের গল্পটাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। রাঙাবালি, নিঝুম দ্বীপসহ বিভিন্ন এলাকায় নদীর নিচ দিয়ে সাবমেরিন কেব্লের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। আর যেখানে গ্রিড লাইন নেই, সেখানে সোলার প্যানেল করা হচ্ছে।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল, আমাদের হাওর-বাঁওর অঞ্চল, আমাদের দুর্গম এলাকা- প্রতিটি জায়গায় কিন্তু আমরা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ দিয়ে দিচ্ছি। কোনো ঘর অন্ধকারে থাকবে না। প্রতিটি মানুষের জীবন আলোকিত হবে। এটাই তো আমাদের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে আমরা আলো জ্বালতে পারলাম। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা যে আমরা আলোকিত করেছি এ দেশের মানুষের প্রত্যেকের ঘর।’
ঘরহীন মানুষের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই করার কথাটি আবারও পুনর্ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না, ঠিকানাবিহীন থাকবে না। একটি মানুষও আর কষ্ট পাবে না। ইনশাল্লাহ সেটাও আমরা করে ফেলব, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধন্যবাদ জানান বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগকারী ও নির্মাণে সহযোগিতাকারী দেশ চীনকেও।
দক্ষিণাঞ্চল একসময় অবহেলিত ছিল জানিয়ে টানা তিন মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার উন্নয়ন পৌঁছে দিয়েছে পুরো জনপদে। গবেষণার মাধ্যমে লবণাক্তসহিষ্ণু ধান ও বীজ উৎপাদনে বাংলাদেশে সক্ষমতা উঠে আসে তার বক্তব্যে।
তিনি বলেন, ‘যে সমস্ত এলাকা একসময় ঝড় জলোচ্ছ্বাসে পানি এদিক থেকে ওদিকে বয়ে যেত, মানুষের একটামাত্র ফসল তাও নষ্ট হলে দুর্ভিক্ষে পড়তে হতো, আল্লাহর রহমতে আর সেই দুর্ভিক্ষ হবে না, আর মানুষের কষ্ট থাকবে না। আজকে মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবে, উন্নত জীবন পাবে। জাতির পিতার স্বপ্ন আমরা পূরণ করব, এটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দক্ষিণাঞ্চলের সুরক্ষায় সবুজ বনায়ন বা উপকূল সবুজায়ন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘এটা কিন্তু আমাদের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে করতে হবে। আষাঢ় মাস থেকে আমরা বৃক্ষরোপণ করি। গাছ লাগাবেন, নিজেও লাভবান হবেন, পরিবেশ ভালো থাকবে। কাজেই সেদিকেও সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে।’
এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে সেটি নিশ্চিত করার জন্য আবারও সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘যার যতটুকু সাধ্য আছে, প্রত্যেকে সেই জমিতে যে যা পারেন, আমি সোজা বাংলায় বলব, যদি একটা কাঁচা মরিচ গাছ লাগাতে পারেন, তাও লাগাবেন। কিন্তু সবাই কিছু না কিছু নিজেরা উৎপাদন করবেন। কৃষকের পাশে দাঁড়াবেন।’
বক্তব্যের শুরুতে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর প্রায় দুটি বছর অনেকটা গৃহবন্দি। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, তার মাধ্যমে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি।’
করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়ে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান সরকারপ্রধান।
যুব সমাজকে স্বনির্ভর হওয়ার পরামর্শ জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা কিন্তু সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছি। লেখাপড়া শিখে নিজেরা উদ্যোক্তা হতে পারবে। নিজেরা উদ্যোক্তা হয়ে নিজেরাই ব্যবসা-বাণিজ্য করে আরও দশটি মানুষকে চাকরি দিতে পারবে। সেইভাবে যুব সমাজকে চিন্তা করতে হবে।’