দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ লবণাক্ত বনভূমি সুন্দরবন। এই বন থেকে প্রায় ২০ বছর ধরে মাছ, মধু ও কাঁকড়া আহরণ করছেন খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের আমজাদ হোসেন।
আমজাদের আক্ষেপ, বনের যেসব জায়গায় মাছ বা কাঁকড়া বেশি পাওয়া যায়, সেগুলোয় জেলেদের ঢোকা নিষিদ্ধ। আর যেসব খাল বা নদীতে ঢোকার অনুমতি আছে, সেগুলোয় মাছ কম। অনেক জেলে সেখানে একত্রে মাছ-কাঁকড়া আহরণ করায় ভাগে কম পড়ে।
তিনি বলেন, ‘আমরা সাত দিন বনে যাই। আবার সাত দিন বাড়িতে থাকি। এ হিসাবে এক মাসে মাত্র ১৫ দিন সুন্দরবন থেকে রোজগার করতে পারি। পূর্ণিমা বা অমাবস্যার সময় ছাড়া বনে মাছ বা কাঁকড়া পাওয়া যায় না। এক মাসে একটি পূর্ণিমা ও একটি অমাবস্যা থাকে। সেই সময়ে আমরা এক সপ্তাহ করে বনে থাকি।’
জেলেরা বন বিভাগ থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া শিকারে ঢোকেন। একেক নৌকায় সাত দিনে যে মাছ বা কাঁকড়া পাওয়া যায়, তা ৬ থেকে ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হয় বলে জানান তারা। প্রতিবারের শিকার অভিযানে প্রায় ২ হাজার টাকার মালামাল নিয়ে যেতে হয়। এ ছাড়া বন বিভাগের অনুমতি নিতেও সরকারকে রাজস্ব দিতে হয়।
সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করছেন মৌয়ালিরা।
জেলে আমজাদ বলেন, ‘২০ বছর ধরে এভাবে বনের ওপর নির্ভর করে উপার্জন করে আসছি। নদীর চরে ছোট একটু সরকারি জায়গায় বনের গাছ ও গোলপাতা দিয়ে ঘর বেঁধে থাকি। কোনো বাড়তি টাকা সঞ্চয় করতে পারিনি। যখন বনে মাছ বা কাঁকড়া কম পাই, তখন অর্ধাহারে-অনাহারে আমাদের পরিবারের দিন কাটে।’
জীবিকার জন্য সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল খুলনার দাকোপ উপজেলার নলিয়ান থেকে কালাবগী পর্যন্ত হাজার হাজার বনজীবী।
সম্প্রতি ওই এলাকার অন্তত ৩০ জন বনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তারা জানিয়েছেন, আগের চেয়ে সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়ার পরিমাণ কমেছে অনেক।
সুন্দরবনে মাছ ধরছেন জেলেরা।
এ ছাড়া বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় মাছ-কাঁকড়া আহরণ বন্ধ থাকে। সে সময় বনজীবীদের জীবিকার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা থাকে না। সঙ্গে রয়েছে বাঘ-কুমিরের আক্রমণে প্রাণ হারানোর সার্বক্ষণিক ভয়।
সুন্দরবন থেকে প্রায় ১২ বছর ধরে মধু সংগ্রহ করছেন মৌয়াল রেজাউল গাজী। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতি বছরে তিন মাস করে বনে মধু আনতে যাওয়ার অনুমতি পাই। বাকি সময় বনের মাছ বা কাঁকড়া আহরণ করি।’
তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করার সময় বাঘের আক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। কারণ মৌচাক খুঁজতে বনের মালের (ভূমিতে) মধ্যে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা ঘুরে বেড়াই, চোখ থাকে গাছের ওপরের দিকে। নিচ থেকে বাঘের আক্রমণ হলে কিছু করার থাকে না।’
এমন ঝুঁকির সঙ্গে রয়েছে দাদনদারদের চাপ। তাই বাধ্য হয়েই ঝুঁকির মধ্যে বনে মৌচাক খুঁজতে যেতে হয় বলে জানান রেজাউল গাজী।
সুন্দরবন থেকে চিংড়ি মাছ ধরছেন জেলেরা।
বলেন, ‘আমরা দলে ৫ থেকে ১০ জন থাকি। ৭ দিনে যে মধু পাই, তাতে একেক জনের ভাগে ৬ থেকে ৭ হাজার করে টাকা থাকে।’
নিউজবাংলা কথা বলেছে কয়েকজন বাওয়ালির সঙ্গেও। বাওয়ালি নজরুল সানা বলেন, 'আমি কর্মচারী হিসেবে গোলপাতা কাটতে বনে এসেছি। এর জন্য আমাকে ১৫ হাজার টাকা মাইনে দেবেন। প্রায় দেড় মাস আমরা বনে থাকব। আমাদের নৌকায় মোট ২ জন বাওয়ালি আছেন।’
এখন আর গোলপাতার চাহিদা তেমন নেই। তাই আয়ও নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহাফুজুর রহমান মুকুল বলেন, ‘বনে এখন সম্পদ কম, আবার বনজীবীর সংখ্যাও বেড়েছে। তাই বন থেকে পর্যাপ্ত উপার্জন করতে পারেন না বনজীবীরা। এ জন্য সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে বন সুরক্ষার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান করলে সুন্দরবন সুরক্ষিত থাকত।’
তিনি বলেন, ‘বন বিভাগ একটি গবেষণা করতে পারে যে বনের কতটুকু সম্পদ আহরণযোগ্য। সেই অনুযায়ী বনজীবীর সংখ্যা নির্ধারণ করে বনে প্রবেশ করতে দিলে সমস্যা হতো না। তবে বন বিভাগের কাছে যে কেউ গিয়ে অনুমতি চাইলেই বনে প্রবেশের অনুমতি পেয়ে যায়। এতে বনজীবীরাও লাভবান হন না, অন্যদিকে সুন্দরবনেরও ক্ষতি হয়।’
কমছে না বিষ দিয়ে মাছ শিকার
সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের কালাবগি স্টেশন অফিসার মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে এখন কাঠ পাচার ও হরিণ শিকার প্রায় শূন্যের কোঠায় নামানো সম্ভব হয়েছে। তবে বিষ দিয়ে মাছ শিকার রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল স্টেশন অফিসার মো. আজাদ কবীর বলেন, সুন্দরবনে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা জরুরি। তা না হলে বিষ দিয়ে মাছ শিকার রোধ করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, সুন্দরবন মাছ প্রজননের একটি নিরাপদ স্থান হওয়া উচিত। কোনো একটি খালে অসাধু জেলেরা বিষ দিলে পানির অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। ফলে মাছের পোনা থেকে শুরু করে বড় মাছ পর্যন্ত সবই মারা যায়।
সুন্দরবনে প্রায় ১০ বছর ধরে চরপাটা জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন আনিচুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কোনো একটি খালে যদি কেউ বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে, তবে পরবর্তী ১৫ দিন ওই খালে চরপাটার জালে কোনো মাছ পাওয়া যায় না। খালে মাছই থাকে না।’
সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে বন বিভাগের কাছে আটক হয়েছেন এমন কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা বলেছেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক। তারা জানান, বনে স্বাভাবিকভাবে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। খালে বিষ দিলে অনেক মাছ একসঙ্গে পাওয়া যায়। যে কারণে জেলেরা বিষ প্রয়োগ করেন।
খুলনা অঞ্চলের নদ-নদী ও পরিবেশ নিয়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে গবেষণা করছেন গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি বলেন, ‘জেলেরা হতদরিদ্র মানুষ। তারা বাড়তি লাভের আশায় বনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরে। এটা তারা প্রয়োজনের তাগিদে করে। তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান করা গেলে বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। তখনই বন নিরাপদ হবে।’
বনের সম্পদ আহরণে ক্ষতি হয় বাস্তুতন্ত্রের
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলছেন, ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবে বন থেকে সম্পদ আহরণ না করা হলে স্বাভাবিক ইকোসিস্টেমের (বাস্তুতন্ত্র) ক্ষতি হয়।’
তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন থেকে একেবারেই কোনো গাছ কাটতে দেওয়া উচিত নয়। বর্তমানে অন্যান্য গাছ কাটা বন্ধ হলেও গোলপাতা কাটা বন্ধ হয়নি। বনের গাছ থেকে ফল পড়বে সেই ফল জোয়ার-ভাটায় অন্য স্থানে গিয়ে নতুন গাছ জন্মাবে। মরে যাওয়া গাছ মাটিতে মিশে জৈব সার সৃষ্টি করবে। এটা বনের স্বাভাবিক ইকোসিস্টেম।’
তিনি বলেন, ‘মাছ আহরণে নির্দিষ্ট এলাকা ঠিক করে রাখা উচিত, যেখানে মাছেরা প্রজনন ঘটাবে। সেখানে জেলেদের প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত নয়। আর বিষ দিয়ে মাছ শিকারের ঘটনা ঘটলে তো একেবারে খারাপ অবস্থা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজস্ব নিয়ে বনজীবীদের সম্পদ আহরণের অনুমতি দেওয়া হয়। সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আসছে এই চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দিতে হবে। বিরক্ত না করে বনটাকে বনের মতো থাকতে দিতে হবে। তা হলে সেখানের ইকোসিস্টেমের কোনো ক্ষতি হবে না।’
এ প্রসঙ্গে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মহসিন হোসেন বলেন, বর্তমানে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ স্থান অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে কোনো জেলে, বাওয়ালি বা বনজীবী প্রবেশ করতে পারে না। ভবিষ্যতে আরও এলাকায় অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হবে।
যা বলছে বন বিভাগ
বন বিভাগের তথ্য মতে, সুন্দরবন থেকে সরাসরি সম্পদ আহরণ করে জীবিকা উপার্জন করে ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ। আর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বনের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানসহ বনের সুরক্ষায় বেশ আগে একটি প্রকল্প পাঠানো হয়েছিল। তবে সেটি থেকে বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থান বাদ রেখে পাস হয়েছে।’
‘ফলে যেটি পাস হয়েছে, সেই প্রকল্পের আওতায় বনে বিদ্যমান অবকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরি ও বনে টহল শক্তিশালী করা হবে।
বন বিভাগের তথ্য মতে, সুন্দরবন থেকে সরাসরি সম্পদ আহরণ করে জীবিকা উপার্জন করে ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ।
‘একই সঙ্গে সম্পদের পরিমাণ, বন্যপ্রাণীর সংখ্যা, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, রোগ-বালাই, রক্ষিত বনাঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও জলজ সম্পদ পরিমাপ করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মাটি ও পানির লবণাক্ততা পরীক্ষা সংক্রান্ত জরিপকাজ সম্পাদনের মাধ্যমে পরিবীক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও মরে যাওয়া নদী খনন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের টাকা ছাড় হতে শুরু করেছে। সে অনুযায়ী কাজ চলছে।’
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মহসিন হোসেন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছি বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার। নতুন করে আবারও প্রকল্প করে আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব।’