পিঠা, নাড়ু, মোয়া, ক্ষীর, মিঠাই- প্রতিটি মিষ্টান্নই অতি সুস্বাদু। বিশেষত ‘জামাই আপ্যায়নে’ অদ্বিতীয়। আর এই ব্যতিক্রমী স্বাদের খাবার তৈরি হয় বিশেষ এক ধরনের চিনি দিয়ে। নাম ‘লাল চিনি’।
কোনো ধরনের রাসায়নিকের উপস্থিতি ছাড়াই ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় শতাব্দী ছাড়িয়ে যাওয়া সময় ধরে সনাতন পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে লাল চিনি। হাড়ভাঙা পরিশ্রমে সুস্বাদু এই চিনি উৎপাদন করে পরিবারের ভরণপোষণ করছেন এখানকার কৃষকরা। কিন্তু নানা কারণে ঐতিহ্যের এই আবাদ-উদ্যোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কৃষকরা। ইতোমধ্যে অনেক কৃষকই আবাদ পাল্টে ঝুঁকেছেন অন্য ফসলে।
স্থানীয়রা জানান, ফুলবাড়িয়া উপজেলায় এখনো নতুন জামাইকে লাল চিনির গরম ক্ষীর ও মোয়া দিয়ে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ আছে। জামাইরা এগুলো খেয়ে তুষ্ট হন।
চাহিদা আছে দেশজুড়েই। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকাররা এই চিনি কিনে নিয়ে বিক্রি করেন। তবে চিনির ন্যায্য দাম না পাওয়া, শ্রমিক ও উন্নত চারার সংকট, সার ও কীটনাশকের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বহু কৃষককে এই চিনির কাঁচামাল আখের আবাদ বন্ধ করে দিয়েছেন।
চাষিরা জানান, লাল চিনি তৈরি যথেষ্টই পরিশ্রমের কাজ। আখ কেটে ইঞ্জিনচালিত মেশিনে মাড়াইয়ের মাধ্যমে রস সংগ্রহ করা হয়। এরপর ড্রামে করে রস নিয়ে জ্বাল-ঘরের ভেতরে ৮ থেকে ১০টি চুল্লিতে বড় লোহার কড়াইয়ে জ্বাল দিতে হয়। কাঁচা রস ঘণ্টাখানেক জ্বাল দেয়ার পর তা ঘন হয়ে এলে কড়াই নামিয়ে কাঠের তৈরি ডাং (হাতল) দিয়ে গরম রসে দ্রুত ঘর্ষণ চালাতে হয়। আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে সেই রস জমতে থাকে। দ্রুত ঘর্ষণের ফলে একপর্যায়ে বালুকণার মতো হয়ে সেই রস লাল চিনিতে রূপ নেয়।
সরেজমিনে রাধাকানাই ইউনিয়নের পলাশতলী (মধ্যপাড়া) গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আখ থেকে রস সংগ্রহ করে চিনি উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক-কিষানিরা। জ্বালাঘরে আগুনের প্রচণ্ড উত্তাপ। তার মধ্যেই ফুটন্ত রসে ডাং দিয়ে দ্রুত ঘর্ষণ চলছে। একেকজন ঘেমে একাকার। কিন্তু থামার সুযোগ নেই। কষ্ট-ক্লান্তি ভুলে কাজ করে চলেছেন তারা।
কথা হলো আখ চাষি আব্দুল জব্বারের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটা সময়ে উপজেলার প্রায় সর্বত্র আখের আবাদ হতো। বর্তমানে লাল চিনির ন্যায্য দাম না পাওয়া, আখের উন্নতজাতের অভাব, শ্রমিক সংকট, সার ও কীটনাশকের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে অনেকে আখ চাষ থেকে সরে এসেছে। যে কৃষক এক সময় চার বিঘা জমিতে আখ চাষ করতেন, এখন তিনি শুধু নিজের প্রয়োজন মেটাতে ৫ থেকে ৬ কাঠা জমিতে আখের চাষ করছেন। কোনো রকমে পরিবারের ভরণপোষণসহ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতেই লাল চিনি উৎপাদনে এখনো সম্পৃক্ত রয়েছি আমরা।’
ফরহাদ মিয়া নামের আরেক কৃষক জানান, প্রতি কাঠা জমিতে উৎপাদিত আখে ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি রস হয়। তা থেকে ১৫০ থেকে ১৬০ কেজি লাল চিনি পাওয়া যায়। সরকারিভাবে কোনো সাহায্য মেলে না। বাজারেও পণ্যমান অনুযায়ী ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য অনেকে লাল চিনি উৎপাদনে উৎসাহ হারাচ্ছেন।
উপজেলায় একটি লাল চিনি গবেষণাগার স্থাপনের দাবি জানান তিনি।
স্থানীয় ফরহাদ হোসেন নামের এক বয়োবৃদ্ধ বলেন, ‘আমাদের উপজেলায় নতুন জামাইকে লাল চিনির গরম ক্ষীর ও মোয়া দিয়ে আপ্যায়ন করার রেওয়াজ এখনো আছে। এ ছাড়া যেকোনো মেহমান এলেও এভাবেই আম্পায়ন করা হয়। লাল চিনি আমাদের ঐতিহ্য। ৫ বছর আগেও যেদিকে তাকিয়েছি শুধু আখের খেত চোখে পড়েছে। বর্তমানে আখ চাষে কৃষকের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। লাল চিনির উৎপাদন ধরে রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।’
লাল চিনি ও এর সম্ভাবনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল উপজেলা কৃষি অফিসও। উন্নত জাতের আখ উৎপাদনে সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দিলেন ফুলবাড়িয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই উপজেলায় গত বছর ১ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। এর আগের বছর ১ হাজার ২৪০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। প্রতিবছর আখের উৎপাদন বাড়াতে উন্নত জাতের আখ চাষের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। এ জন্য পাবনার ঈশ্বরদীতে অবস্থিত বাংলাদেশ সুগার ক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিএসআরআই-৪১ ও বিএসআরআই-৪২ জাত সংগ্রহ করে অনেক কৃষককে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় জাতের চেয়ে এটি এক-তৃতীয়াংশ বেশি উৎপাদন হয়।’
দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কৃষকের হাতে তৈরি লাল চিনির গুণের কথা বলতে গেলে, এটি শুধু মজাদারই নয়, স্বাস্থ্যসম্মতও বটে। যেহেতু এটি সনাতন পদ্ধতি, তাই এটিকে কিভাবে আরও মানসম্পন্ন করা যায়, সেদিকে আমরা নজর দিচ্ছি। আখের উন্নত জাতগুলো ছড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তারা এখানে বিনিয়োগ করলে কৃষকরা চিনি উৎপাদনে আরও উৎসাহিত হবেন। বাড়বে উৎপাদনও।