পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে পাল্টে গেছে পটুয়াখালীর দৃশ্যপট। জাতীয় অর্থনীতির পাশাপাশি কেন্দ্রটি আঞ্চলিক অর্থনীতিতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। যে কারণে এটিকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে নেয়া হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
পুরোপুরি অজপাড়া গাঁর এই এলাকাটি এখন আলো ঝলমলে। ছয় বছর আগেও মানুষ এখানে সড়কের কথাই ভাবতে পারেনি, সেখানে এখন উঠছে বিমানবন্দরের দাবি। মাছ ধরাই ছিল যাদের একমাত্র জীবিকা, এখন তারা অনেক কিছু করে।
ঘরে বিদ্যুৎ আসবে- এই স্বপ্ন দেখতে না পারা মানুষ এখন নিজের চোখেই দেখছে, তাদের এলাকায় উৎপাদিত বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করছে গোটা দক্ষিণাঞ্চল।
যাদের জমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র, তারা বসবাস করত কুঁড়েঘরে। তারা এখন বাস করে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার বাসভবনে। যে এলাকা ছিল শহর থেকে শত কিলোমিটার দূরে, সেই এলাকা এখন উন্নত শহরের রূপ ধারণ করে আছে।
পড়াশোনা করে উন্নত ভবিষ্যৎ গড়া এক সুদূরপরাহত স্বপ্ন ছিল যে শিশু-কিশোরদের, তারা এখন কারিগরি শিক্ষা নিচ্ছে। পড়া শেষেই চাকরি- এমন আশ্বাসও দেয়া হয়েছে। এর সবকিছুই হয়েছে পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এই কেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে জাতীয় গ্রিডে। তবে সোমবার কেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শুরু হবে বাণিজ্যিক উৎপাদন।
তবে কেন্দ্রটি আপাতত তার উৎপাদনক্ষমতার অর্ধেক ব্যবহার করবে। যে দুটি সঞ্চালন লাইন তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তার মধ্যে একটি হতে না পারায় অন্য একটি ইউনিটকে বসিয়ে রাখতে হবে চলতি বছরের বাকি সময়। এটুকু বাদ দিলে এই কেন্দ্রটিকে দক্ষিণের জীবন ঘুরিয়ে দেয়ার প্রকল্প বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তাকে বরণ করতে প্রস্তুত করা হয়েছে রংবেরঙের দেড় শতাধিক নৌকা। এগুলো ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিসংলগ্ন রাবনাবাদ নদী মোহনায় সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। প্রতিটি নৌকায় বর্ণিল পোশাকে পাঁচজন করে জেলে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাবেন।
দারুণ লাগছে। জীবনে কল্পনাও করি নাই মোগো এইহানে এত সুন্দর চকচকে এত্ত বড় রাস্তা অইবে। হাজার হাজার বড় গাড়ি এহোন এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া হরে
বিদ্যুতের জেটি পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রীকে ভিন্নমাত্রার আনন্দ দিতে এবং উপকূলের জীবনযাত্রা এই নৌকার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে কর্তৃপক্ষ এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বরিশালের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ১০ জন শিক্ষার্থী এক সপ্তাহ ধরে এ নৌকাগুলোকে প্রস্তুত করেছেন।
পাল্টে গেল জীবন, বাড়ছে স্বপ্ন
২০১৬ সালে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের সড়কগুলো ছিল কাদামাটিতে ভরপুর। তখন পাকা রাস্তা ছিল না বললেই চলে। বিদ্যুতের কথা ভাবা তো ছিল কল্পনার মতো। বলতে গেলে এক ভূতুড়ে এলাকা ছিল গোটা ধানখালী।
ছয় বছর পর পুরো ভিন্ন চিত্র। ধানখালী ইউনিয়নটি এখন শহর হয়ে গেছে। সেখানে এখন চার লেনের সড়ক। রাতের আলোয় মনে হয় দেশের ব্যস্ততম কোনো শহরের দৃশ্য।
পাঁচ বছর আগে যে মাটির রাস্তায় বাইসাইকেল আর ভাড়ায় মোটরসাইকেল ছিল প্রধান বাহন। সেখানে এখন চার চাকার যানবাহনে ব্যস্ত থাকে ২৪ ঘণ্টা।
গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনের রাস্তায় নতুন ইজিবাইক নিয়ে বসেছিলেন চালক সাইফুল ইসলাম। তিনি নৌকা নিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন, যেটা ছিল অনেক কষ্টের। সে সময় তার বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না, এখন নিজ ঘরে রাতে ইজিবাইক চার্জ দিয়ে সকালে রাস্তায় নামেন যাত্রী আনা-নেয়ার কাজে।
সাইফুল বলেন, ‘দারুণ লাগছে। জীবনে কল্পনাও করি নাই মোগো এইহানে এত সুন্দর চকচকে এত্ত বড় রাস্তা অইবে। হাজার হাজার বড় গাড়ি এহোন এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া হরে।’
সোমবারের বাজারের দোকানদার ছোবাহান মিয়া বলেন, ‘মোর দোহানে এহন ফ্রিজও আছে। ভালোই বেচাকেনা অয়। আগে মুইও নদীতে জাল হালাইতাম। মাঝেমধ্যে মাছ পাইতাম আবার কহোনো পাইতাম না। সংসার চালাইতে মোর অনেক কষ্ট অইত। কিন্তু এই কেন্দ্রের লাইগ্যা এই এলাকার অনেক উন্নতি হইছে।
‘রাইত ১১-১২ডা পর্যন্ত লোকজন থাহে মোর দোহানে আর আগে এই বাজারে মোরা থাকতাম রাইত ৮টা পর্যন্ত। তহন দোহান ছিল হাতে গোনা দু-চাইরডা। আর এহন দেহেন দোহানের পর খালি দোহান আর দোহান।’
ঢাকার বড় বড় পার্টি এসে কানি কানি জমি কিনছে। এখন সেই সব জমি বালু দিয়ে ভরাটের কাজ চলছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই এসব এলাকায় বড় বড় দালানকোঠায় ভরে যাবে।
পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী রেদওয়ান ইকবাল বলেন, ‘১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণেই মূলত এ পরিবর্তন। শুধু সড়কই নয়, এখানে গড়ে উঠছে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি। বেড়ে গেছে এখানকার জমির মূল্যও।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন প্রথমে ২০১৬ সালে এখানে এসেছি, অনেক নৌকায় পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে। ছোট ছোট খাল ছিল আর ছিল মাইলের পর মাইল বিল। পাকা রাস্তা ছিল না। আর আজ সেখানে ফোর লেনের কাজ সমাপ্তির পথে। এর পরই আবার শুরু হবে সিক্স লেনের কাজ।’
কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা হানিফ চৌকিদারের সঙ্গে। তিনি জানান, এখানকার জমির দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তবে মূল সড়কের পাশে কোনো খালি জমি নেই। সব বিক্রি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ঢাকার বড় বড় পার্টি এসে কানি কানি জমি কিনছে। এখন সেই সব জমি বালু দিয়ে ভরাটের কাজ চলছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই এসব এলাকায় বড় বড় দালানকোঠায় ভরে যাবে।’
তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শাহ আব্দুল মওলা বলেন, ‘ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে এখানকার অধিবাসীদের। কর্মসংস্থানের সুযোগসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসী নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সুযোগ পাবে এখান থেকে।’
পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনের সংসদ সদস্য মহিবুর রহমান বলেন, ‘তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর আর পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটাকে সামনে রেখে কলাপাড়ায় একটি বিমানবন্দর করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। ভোলা ও বরিশালে গ্যাস সরবরাহ আছে। পটুয়াখালী জেলায় সরকারের এতগুলো মহাপ্রকল্প চলমান থাকা সত্ত্বেও এখানে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না। এ বিষয়টি আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরব।'
১২ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি সোমবার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উন্নত আবাসন, কর্মসংস্থানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পশ্চিম পাশেই করা ‘স্বপ্নের ঠিকানা’র অবস্থান। কেন্দ্র করতে গিয়ে গৃহহারাদের পুনর্বাসন করতে গড়া হয়েছে আধুনিক এ প্রকল্পটি।
এখানে ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের ১৩০টি ঘর ছাড়াও বসবাসকারীদের সুবিধার্থে রয়েছে স্কুল, মসজিদ, কমিউনিটি ক্লিনিক, দুটি পুকুর ও প্রতি চারটি পরিবারের জন্য একটি করে ডিপ টিউবওয়েল।
ঘর নিয়ে আক্ষেপ নেই। তবে ‘এ’ ‘ব্লকের ১৭ নম্বর ঘরের মালিক রানী বেগম বলে, ‘জমির তিন গুণ দাম দেওয়ার কতা থাকলেও মোগো হ্যারা দেয় নাই। মোগো পরিবারের সদস্যদের চাকরি দেওয়ার কতা, হেডাও হরে নাই। মাঝেমধ্যে কামকাইজ করত, প্ল্যান্টে এহনও হেডাও বন্ধ। মূল গেট বন্ধ কইরা অন্য এলাকার লোকদের দিয়া কাম হরায়। এই ঘরডা দিয়ে মোরা হরমু কী? সংসার চলে না। কামকাইজ করতে পারে না পুরুষরা। আপনাগো লগে কতা কইতেও ভাল্লাগে না।’
একই অভিযোগ করলেন ‘বি’ ব্লকের ৩০ নম্বর ঘরের মালিক সেলিম হাওলাদার, ১৬ নম্বর ঘরের মালিক আলামিন, ৬২ নম্বর ঘরের মালিক নাইম ও ফজিলাতুন্নেছা।
কারিগরি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন দেশের ভাষা শেখানো হচ্ছে, যাতে বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করা সম্ভব হয়। তা ছাড়া এখানে শুধু এখানকার অধিবাসীরাই নয়, গোটা জেলার যে কেউ ভর্তি হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।
সেমিপাকা ঘর, পাকা টয়লেট আর খোলা মাঠ ও বড় বড় পুকুর পেয়ে এরা সবাই যতটা খুশি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হতাশা বিরাজ করছে এদের মধ্যে। পরিবারের অন্তত একজন সদস্যেরও যদি কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়, সেই দাবি তাদের।
তবে এখানকার বাংলাদেশ-চায়না কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে অনেক শিক্ষার্থী বেজায় খুশি। এখানে সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তিনটি গ্রেডে ক্লাস নেয়া হয়। ৯ জন শিক্ষক, দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। এখানে কম্পিউটার, ইলেকট্রিক্যালসহ তিনটি গ্রেডে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ শেষে চাকরির সুযোগ হবে বলে আশাবাদী দশম শ্রেণির ছাত্র সজিব হোসেন।
একই শ্রেণির ছাত্র মজিবুর রহমান রনি বলেন, ‘যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্যই মূলত এখানে গড়ে তোলা হয়েছে এই কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তরা নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে নিতে পারবে।’ আরেক ছাত্র ইব্রাহিম প্যাদা জানিয়েছে, তাদের জন্য বিনা মূল্যে টিফিন এবং পোশাক দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী রেদওয়ান ইকবাল বলেন, ‘কারিগরি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন দেশের ভাষা শেখানো হচ্ছে, যাতে বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করা সম্ভব হয়। তা ছাড়া এখানে শুধু এখানকার অধিবাসীরাই নয়, গোটা জেলার যে কেউ ভর্তি হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।‘
পায়রা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শাহ আব্দুল মওলা বলেন, ‘এই কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে শিক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের জন্য চাকরির দরজা খোলা থাকবে। অতএব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা চাকরি পায়নি এ কথাটা সঠিক নয়। তারা সবাই চাকরি পাবে পর্যায়ক্রমে।
পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনের সংসদ সদস্য মহিবুর রহমান জমির মূল্য আর চাকরি না পাওয়ার বিষয় অস্বীকার করে জানান, ‘এটি মিথ্যা কথা। কারণ তাপবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তাদের প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিয়েছে। এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।’