‘আমার বাবার লাশ চাই। লাশ না নিয়া বাড়ি যামু না। যেই জাহাজ লঞ্চটারে ডুবায় দিয়া মানুষগুলো মারল, হেই জাহাজের ড্রাইবারের ফাঁসি চাই।’ শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নিখোঁজ বাবার অপেক্ষায় থাকা কাকলী বেগম আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে মাত্র এক মাস আগেই কাকলীর বাবা হাতেম আলী কুয়েত থেকে দেশে ফিরেছিলেন। রোববার রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসক দেখিয়ে মুন্সীগঞ্জের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর থেকে তার ফোন বন্ধ। পরে লঞ্চডুবির খবর পেয়ে শীতলক্ষ্যার পাড়ে আসেন তার স্বজনরা।
কাকলী বলেন, ‘আমার বাবার মোবাইল বন্ধ পাইছি। টিভিতে দেখি মুন্সীগঞ্জের লঞ্চ ডুইবা গেছে। নদীর পাড়ে আইসা দেখি উদ্ধারের কাজ চলতাছে। আমার বাবারে পাইতাছি না। আমার বাবারে আইনা দেন।’
শুধু হাতেম আলী নন, তার মতো নিখোঁজ রয়েছেন সোনারগাঁর একটি স্কুলের শিক্ষক উম্মে খায়রুন ফাতেমা। নদী সাঁতরে তীরে এসে বুক চাপড়িয়ে কাঁদছিলেন তার স্বামী প্রফেসর আবু তাহের সরকার।
বিলাপ করে আবু তাহের সরকার জানান, স্ত্রীর হাত ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু নদীর স্রোত আর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হাতটি ছুটে যায় নিমেষেই।
লঞ্চডুবির সংবাদ পেয়ে শীতলক্ষ্যার পাড়ে ছুটে এসেছেন আবু তাহেরের সহকর্মীরা। তাদের মধ্যে দেলোয়ার হোসেন জানান, আবু তাহের সরকার ও তার স্ত্রী উম্মে খায়রুন ফাতেমা ডুবে যাওয়ায় লঞ্চটির সামনের দিকে ছিলেন। জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চটি কাত হয়ে গেলে এই শিক্ষক দম্পতি নদীতে পড়ে যান।
আরেক সহকর্মী আক্তার হোসেন জানান, আবু তাহের সরকার সোনারগাঁ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রফেসর। তার স্ত্রী সোনারগাঁ বৈদ্যার বাজার খারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
নিখোঁজ উম্মে খায়রুন ফাতেমার চাচা বলেন, ‘লঞ্চটারে ডুবায় দেয়া জাহাজের চালকের শাস্তি চাই৷ তারা শাস্তি পায় না দেইখা এমন ঘটনা বাববার ঘটছে।’
নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় মুন্সীগঞ্জগামী এম এল আশরাফ উদ্দিন নামে যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
লঞ্চডুবির খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও বিআইডব্লিউটিএর ডুবুরিদল। বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ আছে ঘটনাস্থলে।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জানান, মাঝ নদীতে ডুবে যাওয়া লঞ্চটিকে শনাক্ত করা হয়েছে। জাহাজ প্রত্যয় সেটিকে ওঠানোর চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ নিখোঁজদের সন্ধান মিলবে না, ততক্ষণ অভিযান চলবে।’
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক জিল্লুর রহমান জানান, নিহত ৬ জনের মধ্যে পাচঁজনের মরদেহ নদীর তলদেশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে দুই নারী, দুই পুরুষ ও দুই শিশু রয়েছে।
তিনি জানান, আনুমানিক ৫০ যাত্রী নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে যায় লঞ্চটি। পরে পেছন দিক থেকে এমভি রূপসী-৯ নামে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায় এটি। আনুমানিক ২০ থেকে ৪০ যাত্রী সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছাতে পেরেছেন।
লঞ্চডুবির ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্যোগে আলাদা তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।