ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আতঙ্কে শেয়ারের দরপতনের স্মৃতি ফিরে এসেছে দেশের পুঁজিবাজারে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি একদিনে শেয়ারের দরপতনের যে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই সীমার মধ্যে বেশিরভাগ শেয়ারেরই ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা ছিল, তারাও সংখ্যায় কম।
সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রোববার লেনদেন শুরু হয়েছিল সূচক বেড়ে। সে সময় বেশিরভাগ শেয়ারের দর বেড়ে লেনদেন হচ্ছিল।
এর মধ্যে পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক পেজে একটি জাতীয় দৈনিকের একটি সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। এতে বলা হয়, দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ বাতিল করে আগের মতোই ১০ শতাংশ করতে যাচ্ছে বিএসইসি।
সকাল ১০টা ১৫ থেকে শুরু হয় দরপতন। বেলা ২টার দিনে ৭৫ পয়েন্ট পড়ে যায় সূচক। দিন শেষে আগের দিনের চেয়ে ৬৭ পয়েন্ট হারিয়ে শেষ হয় লেনদেন।
টাকার অঙ্কে লেনদেন হয়েছে ৬১৬ কোটি ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, যা ১১ মাসেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম।
এর চেয়ে কম ৬০২ কোটি ৭৬ লাখ ৯১ হাজার টাকা হাতবদল হয়েছিল ২০২১ সালের ১৪ এপ্রিল।
শেয়ারের দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ করার পর সবচেয়ে বেশি সূচক পড়ে রোববার
সারা দিনে কেবল একটি কোম্পানির শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৫০ কোটি টাকার বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে যে কোম্পানির, সেটির শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৩০ কোটি টাকার কম। ২০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়নি আর কোনো কোম্পানির।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলার পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ৮ কর্মদিবসে সূচক পড়ে ৩৮২ পয়েন্ট বা ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
নবম দিনে ৮ মার্চ লেনদেনের শুরুতে দেড় ঘণ্টায় সূচক পড়ে আরও ১৩৭ পয়েন্ট। তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক জেঁকে বসে। সে সময় বিএসইসির দুটি সিদ্ধান্তে ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার।
পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের নির্দেশ দেয় প্রথমে। কিছুক্ষণ পর আসে দ্বিতীয় আদেশটি। জানানো হয়, এক দিনে দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ১০ শতাংশ থাকলেও সর্বনিম্ন সীমা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ২ শতাংশ।
এর পরের চার কর্মদিবসে পুঁজিবাজার ফেরে উত্থানে। সূচকে যোগ হয় ৩০৯ পয়েন্ট।
তবে গত ১৪ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত সূচক বলতে গেলে একটি জায়গায় স্থির ছিল। প্রথম দিন সূচক পড়ে ১.৭৯ পয়েন্ট, পরের দিন বাড়ে ১.৫৪ পয়েন্ট, পরদিন বাড়ে ০.১১ পয়েন্ট।
এই তিন কর্মদিবসেই ৫০টিরও বেশি কোম্পানির দরপতনের সর্বোচ্চ সীমায় লেনদেন হতে দেখা দেয়, যা হয় দেড় শতাধিক।
লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে কেবল ২৬টির, কমেছে ৩৩২টির দর, আর অপরিবর্তিত ছিল ২১টির দর।
এর মধ্যে অন্তত শতাধিক কোম্পানির কোনো ক্রেতা ছিল না, যা পুঁজিবাজারে সচরাচর দেখা যায় না।
বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা নামেই
স্থিতিশীলতা তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ, দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা দুই শতাংশ নির্ধারণ ছাড়াও বাজারে তারল্য বাড়াতে আরও কিছু উদ্যোগ নেয় বিএসইসি।
এর মধ্যে ৯ মার্চ বিএসইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে ৩৩টি ব্যাংকের প্রতিনিধিরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়।
সেদিন মোট তিনটি সিদ্ধান্ত হয়। এক. যেসব ব্যাংকের বিনিয়োগ তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে, তারা কয়েক দিনের মধ্যে ২ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াবে। দুই. ব্যাংকগুলোর জন্য ঘোষিত ২০০ কোটি টাকার ফান্ড এখনও যেসব ব্যাংক গঠন করেনি, তারা তা করবে। এরপর সক্ষমতা অনুযায়ী তারা বিনিয়োগ করবে। তিন. যারা তহবিল গঠন করে এখনও বিনিয়োগ করেননি, তারা বিনিয়োগ করবেন।
পরের দিন মিউচ্যুয়াল ফান্ড পরিচালনা করা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির সঙ্গে বসে বিএসইসি। এই বৈঠক শেষেও বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা আছে।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মৌলভিত্তির কিছু কোম্পানির শেয়ারদর অবমূল্যায়িত হয়ে পড়েছে বলে ফান্ড ম্যানেজাররা মনে করছেন। যেখানে এখন বিনিয়োগে লাভবান হওয়া সম্ভব। তাই ফান্ড ম্যানেজাররা তাদের হাতে থাকা অর্থ দ্রুত বিনিয়োগ করবেন বলে জানিয়েছেন।’
বিনিয়োগ বাড়ানোর এই ঘোষণার পর দুই দিন এক হাজার কোটি টাকার বেশি শেয়ার কেনাবেচা হয়েছিল। এর মধ্যে ১০ মার্চ এক হাজার ৬১ কোটি ২০ লাখ ৬৬ হাজার টাকার পর ১৫ মার্চ এক হাজার ৬৫ কোটি ৬৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা হাতবদল হয়।
১৬ মার্চ লেনদেন কমে হয় ৮৩৫ কোটি ৭০ লাখ ৬২ হাজার টাকা। সেটি আরও কমে গেল আজ।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশের ‘করুণ চিত্র’
দিনে দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছুঁতে পারেনি কোনো কোম্পানি। সবচেয়ে বেশি ৬.৬ শতাংশ দর বেড়েছে তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের দর।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধি পাওয়া পিপলস ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে যোগ হয়েছে ৩.৬৪ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা এইচ আর টেক্সটাইলের দর বেড়েছে ৩.৬০ শতাংশ। চতুর্থ স্থানে থাকা এপেক্স স্পিনিং মিলসের দর বেড়েছে ২.১১ শতাংশ।
বাকি ৬টি কোম্পানির দর বেড়েছে ১.২৬ শতাংশ থেকে ১.৯৪ শতাংশ পর্যন্ত।
আরও তিনটি কোম্পানির দর বেড়েছে ১ শতাংশের বেশি আর এবং বাকি ১৩টির দর ০.০২৯ শতাংশ থেকে ০.৭৫ শতাংশ বেড়েছে।
সবচেয়ে বেশি পতন আইএফআইসির
লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা থাকায় দরপতনের সীমা না থাকার দিন এই ব্যাংকটির শেয়ার দর হারিয়েছে ৭.৬৪ শতাংশ।
গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় আগের বছরের একই সময়ে তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ার পরও সেটি আগের বছরের মতোই ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কখনও নগদ লভ্যাংশ না দেয়া কোম্পানিটির শেয়ারদর গত ১৬ মার্চ ছিল ১৫ টাকা ৭০ পয়সা। সকালে এক ধাক্কায় তা নেমে আসে ১৪ টাকা ১০ পয়সায়। পরে সেখান থেকে কিছুটা বেড়ে ১৪ টাকা ৫০ পয়সায় শেষ হয় লেনদেন।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ শতাংশ করে দর কমেছে এনআরবিসি, আমরা নেটওয়ার্ক, বিডি থাই ফুড, বিডিকম ও কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের দর।
এটলাস বাংলাদেশ, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স, জেনেক্স ইনফোসিস, সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, সোনালী পেপার, প্রোগ্রেসিভ লাইফ, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ, ইস্টর্যান্ড ইন্স্যুরেন্স, জিলবাংলা সুগার, ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স, ইউনিক হোটেলসহ শতাধিক কোম্পানির দর কমেছে একদিন যত কমা সম্ভব ততই।
সূচক পতনে প্রধান ভূমিকায় যেগুলো
সবচেয়ে বেশি ৬.৮ পয়েন্ট সূচক পড়েছে কোম্পানিটির শেয়ারদর ১.৩৪ শতাংশ কমার কারণে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪.৯৫ পয়েন্ট সূচক কমিয়েছে রবির কারণে। কোম্পানিটির শেয়ারদর কমেছে ১.৭২ শতাংশ।
আইএফআইসির শেয়ারদর ৭.৬৪ শতাংশ কমার কারণে সূচক পড়েছে ৩.২১ পয়েন্ট।
এছাড়া আইসিবির কারণে ২.৭৯ পয়েন্ট, লাফার্জ হোলসিম ও ওয়ালটনের কারণে ২.৩৮ পয়েন্ট করে, রেনাটার দরপতনে ২.২৪ পয়েন্ট, স্কয়ার ফার্মার দরপতনে ১.৯৫ পয়েন্ট, পাওয়ারগ্রিডের দরপতনে সূচক থেকে কমেছে ১.২৩ পয়েন্ট এবং বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির দরপতনে সূচক কমেছে ১.০৬ পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানির কারণে সূচক কমেছে ২৮.৯৯ পয়েন্ট।