ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের মধ্যে অষ্টম অংশীদারত্ব সংলাপে বসছে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় রোববার বেলা ১১টায় শুরু হবে এ সংলাপ।
এবারের সংলাপে বাংলাদেশ গুরুত্ব দিচ্ছে র্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টিকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, ইন্দো-প্যাসিফিক জোট ও সামরিক যোগাযোগে গুরুত্ব দিচ্ছে।
সংলাপে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছান। সংলাপে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এবারের সংলাপ হতে পারে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নতুন বাঁক নেওয়ার বিন্দু (টার্নিং পয়েন্ট)। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু চাওয়ার ছিল, কিন্তু সম্প্রতি বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের কাছেও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
ওই সূত্রটি জানায়, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ঘটনায় যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে বিশ্ব রাজনীতির পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের অবস্থান সুসংহত করার বিষয়টি আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির দিক থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ঢাকার কূটনীতিক সূত্রের দাবি, বাইডেন প্রশাসনে ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড প্রভাবশালী কর্মকর্তা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তার ঢাকা সফরে দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
‘যৌথ সহযোগিতার অনেক বিষয় আছে’
সংলাপের আগের দিন শনিবার সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘এ সংলাপে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। বাংলাদেশও গণতান্ত্রিক দেশ। ফলে দুই দেশের মধ্যে বড় মিল আছে।
‘সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই যৌথ সহযোগিতার অনেক বিষয় আছে। সেসব নিয়ে আলোচনা হবে। আশা করছি খুব ফলপ্রসূ আলোচনা হবে। আলোচনা হবে র্যাবের ওপর দেয়া তাদের নিষেধাজ্ঞা নিয়েও।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অংশীদারত্ব সংলাপের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। এ ধরনের আলোচনাকে রাজনৈতিক সংলাপও বলা হয়। সম্প্রতি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান কিছু কর্মকতার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে এ সংলাপের গুরুত্ব এবার অনেক বেড়েছে।
সংলাপে বাংলাদেশ এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিই প্রাধান্য দেবে। এ জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুকে গুরুত্ব দেবে ঢাকা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এর আগের সংলাপে উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গড়ে তুলতে উভয় দেশ সম্মত হয়েছিল। এবারের সংলাপেও বিষয়টি আলোচনায় তুলবে ঢাকা।
ঢাকা-ওয়াশিংটন সামরিক যোগাযোগ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেবে বাংলাদেশ। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কিনতে দুটি চুক্তি করার জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (জিএসওএমআইএ) এবং অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্টের (এসিএসএ) যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তাও খতিয়ে দেখা হবে।
পাশাপাশি বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য জিএসপি সুবিধা চালুর বিষয়ে আলোচনা তুলবে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিত আছে।
এর আগের দুটি সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানবাধিকার পরিস্থিতি, শিশু অধিকার, শ্রম নীতিমালার বাস্তবায়ন, সংখ্যালঘুদের অবস্থা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক সহযোগিতার বিষয়টি তোলা হয়। এ বছর আগের ইস্যুগুলোর পাশাপাশি মানবাধিকার পরিস্থিতিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে।
বাণিজ্য-বিনিয়োগ, সামরিক যোগাযোগের বিষয় আলোচনায় তোলা হবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বিষয় হবে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সরকার অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সম্প্রতি দেশটির কংগ্রেসে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ফলে এবারের সংলাপে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা তুলতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সংলাপটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি। ফলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা সব ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়ার সুযোগ বেশি। এ বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানির ক্ষেত্রে সুবিধা, বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ সংগ্রহ এবং উন্নয়ন ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত করার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত।
‘যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি তুলে ধরবে। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে সংলাপে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করবে।’
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘দুই বছর পর বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্ব সংলাপ হচ্ছে। এটা দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আলোচনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। তা ছাড়া এবার এ আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে দেশের ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড। তিনি এ মুহূর্তে বাইডেন প্রশাসনের অন্যতম প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত।
‘তার ঢাকা সফরও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ কারণে এবারের সংলাপ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একটা টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি এ অঞ্চলে চীনের ক্রমাগত প্রভাব বিস্তার নিয়ে চিন্তিত হয়েই থাকে, তাহলে শুধু চাপ কিংবা নানামুখী ব্যবস্থা নয়; বরং সার্কের মতো আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক জোটগুলোকে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ দেয়া উচিত। এ ধরনের জোট শক্তিশালী হলে সেটা এ অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর একক কোনো দেশের প্রভাব বিস্তারকে রোধ করবে।
‘একই সঙ্গে বাণিজ্য, নিরাপত্তা, জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি এবং ব্লু-ইকোনমিতে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আরও বেশি বিনিয়োগ ও সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত। এ বিষয়গুলো যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় তুলে ধরা উচিত বাংলাদেশের।’
সর্বশেষ ২০১৯ সালে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারত্ব সংলাপ হয়েছিল। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের তৎকালীন আন্ডার সেক্রেটারি (পলিটিক্যাল) ডেভিড হ্যাল।
এবার বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ১৯৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী মাসুদ রোম এবং টোকিওতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পররাষ্ট্রসচিব হওয়ার আগে তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া দিল্লিতে তিনি মিশন উপপ্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন।
অন্যদিকে নুল্যান্ড একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট। ২০০৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তিনি ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ইউরোপে প্রচলিত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত চুক্তি আলোচনায় প্রধান নেগোশিয়েটর হিসেবে ২০১০-১১তে দায়িত্ব পালন করেন।
এর আগে সাবেক আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হিলারি ক্লিনটন যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ছিলেন।
ঢাকার আজকের বৈঠক শেষে সামনের দুই মাসে অন্তত চারটি বৈঠক হবে দুই দেশের মধ্যে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পার্টনারশিপ ডায়ালগের পরে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংলাপ আছে, বাণিজ্যিক ও ব্যাবসায়িক ডায়ালগ আছে এবং অন্যান্য সব বৈঠকের আগে যেহেতু এটি হচ্ছে, সেই অর্থে এটির আলাদা একটি গুরুত্ব আছে।
‘কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এপ্রিল মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটন সফর করবেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। ওই বৈঠকের পর আরও উচ্চপর্যায়ের সফর হওয়া উচিত। আমরা চাইব উনারা আসুক এবং আমরাও যাই।’
তিনি বলেন, ‘জিসোমিয়া ও আকসার নিয়ে অনেক বছর আলোচনা করছে দুই দেশ। জিসোমিয়া ও আকসার বিভিন্ন প্রভিশনগুলো আমরা যাচাই করে দেখছি। অনেক স্টেকহোল্ডার আছে এবং ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়গুলোর জন্য আমাদের নিজস্ব কিছু নিয়ম-কানুন আছে।
‘আমাদের নিয়মের সঙ্গে চুক্তির ধারাগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, সেটি আমরা যাচাই করছি। নিরাপত্তা সংলাপে এটি আরও বড় আকারে আলোচনা হবে।’
ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আলোচনা হবে। গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। আমরা দেখছি যে অর্থনৈতিক বিষয়টি সেখানে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। আমরা সেটিকে গুরুত্ব দিতে চাই।
‘কানেকটিভিটির বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশ যে কাজ করছে, সেটি নিয়েও আমরা আলোচনা করতে চাই। তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগে আঞ্চলিক কানেকটিভিটি নিহিত করা যায় কি না, সেটির বিষয়ে আমাদের আগ্রহ থাকবে।’