সকাল-দুপুরের মাঝামাঝি একটা সময়। ভাটায় শুকিয়ে গেছে নদী। চরের পানিতে এ সময় পাটা জাল ফেলতে ব্যস্ত তিন জেলে। হঠাৎ উৎকট একটা গন্ধ নাকে এসে লাগে।
জেলেদের মধ্যে কামাল নদীর পারে তাকিয়ে দেখেন একটি বাঘ। পলকহীন চোখে চেয়ে আছে তারই দিকে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাঘটি কামালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কামাল বলেন, ‘প্রথমে আমার মাথার বাঁ পাশে একটি থাবা বসিয়ে দেয়। পরে আর কতটি থাবা বা কামড় দিয়েছে, তা জানি না। ততক্ষণে ভয়ে আমার শরীর অবশ। হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে- আমি মরিনি, আমাকে বাঁচাও...।’
কামালের পাশেই ছিলেন আরেক জেলে রুহুল আমিন সরদার। ভয় পাননি তিনি। এগিয়ে গেলেন কামালের দিকে। নদীর কাদামাটি দুই হাত দিয়ে তুলে ছুঁড়ে মারতে থাকেন বাঘটির দিকে।
রুহুলের এমন প্রচেষ্টা ফল পায় অবশেষে।
কামাল বলেন, ‘সম্ভবত সেই কাদামাটি বাঘের চোখে গিয়েছিল। তাই আমাকে ফেলে রেখে চলে যায়। তখন আমার আর জ্ঞান ছিল না।’
এভাবেই বাঘের মুখ থেকে ফেরার গল্প বর্ণনা করলেন কামাল হোসেন গাজী। জীবিকার তাগিদে ঠিক কখন থেকে সুন্দরবনে যাওয়া শুরু করেছিলেন, এখন আর মনে নাই তার।
বাপ-দাদার পেশা তাকে ছাড়েনি। তাই শৈশব থেকেই সুন্দরবনের ওপর জীবিকা নির্ভর করে বেড়ে উঠেছেন। ৩২ বছর বয়সী কামালের এখন তিন সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে সাদামাটা সংসার।
আমি যে বেঁচে আছি, তা হাসপাতাল ভর্তি মানুষের উপস্থিতি দেখেই মনে হলো। সেখানে প্রায় আড়াই মাস চিকিৎসাধীন ছিলাম। পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি। এরপর বাড়িতে বিশ্রামে ছিলাম প্রায় ছয় মাস।
বাঘের মুখে পড়ার সেই ভয়ংকর ঘটনাটি তার জীবনে ঘটেছিল ১৮ বছর বয়সে। বলা যায় ভাগ্যের জোরে কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে মারাত্মক আহত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। তারপর দীর্ঘ চিকিৎসায় একসময় সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সুস্থ হওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যেই আবারও বিপদসংকুল সেই পেশায় নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে গেছে।
কামালের জীবনে বাঘের মুখে পড়ার ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৮ সালের দিকে। দিন-তারিখ মনে নেই তার। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের কাশিয়ানাবাদ স্টেশনের আওতাধীন গেড়াচালকি নদীর তীরেই আক্রমণ করেছিল সেই বাঘটি।
কালাম হোসেন গাজী জানান, রুহুল আমিন সরদার সেদিন আহত অবস্থায় তাকে নদীর চর থেকে তুলে নিয়ে গ্রামে ফিরেছিলেন। পরে পরিবারের লোকেরা তাকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কয়েক দিন চিকিৎসার পর তার জ্ঞান ফিরেছিল।
বাঘের আক্রমণে আমার মাথা ও মুখে অগণিত ক্ষত। ফলে আমার চেহারায়ও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমদিকে মানুষ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে খারাপ লাগত।
কামাল বলেন, ‘আমি যে বেঁচে আছি, তা হাসপাতাল ভর্তি মানুষের উপস্থিতি দেখেই মনে হলো। সেখানে প্রায় আড়াই মাস চিকিৎসাধীন ছিলাম। পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি। এরপর বাড়িতে বিশ্রামে ছিলাম প্রায় ছয় মাস।’
তিনি জানান, সুস্থ হওয়ার দিনগুলোতে তিনি আর সুন্দরবন যাবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এলাকার মানুষের ক্ষেতে-খামারে কাজ করেই জীবিকা নির্বাহের কথা ভাবছিলেন তিনি। বাপ-ভাইয়েরাও নিষেধ করেছিলেন, ‘আর বনে যাস না।’
সুস্থ হয়ে মানুষের বাড়িতে কাজও শুরু করেছিলেন কামাল। তবে যার বাড়িতেই কাজে যান, সবাই তার ক্ষতবিক্ষত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বিষয়টি একসময় বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে।
কমাল বলেন, ‘বাঘের আক্রমণে আমার মাথা ও মুখে অগণিত ক্ষত। ফলে আমার চেহারায়ও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমদিকে মানুষ আমার মুখে তাকিয়ে থাকলে খারাপ লাগত।’
এ ছাড়া বাঘের আক্রমণের কারণে বেশি শারীরিক পরিশ্রম করার সক্ষমতাও তখন কামালের ছিল না। তাই সুস্থ হওয়ার আড়াই বছর পর আবারও সুন্দরবনে যাওয়া শুরু করলেন তিনি।
মনে হয় বন আমাকে ছাড়তে চাইছিল না। তাই ভাগ্যের টানে আবারও আমি বনের পেশায় জড়িয়ে পড়েছি।
কামাল জানান, বনের কাজে তার কোনো ক্লান্তি আসে না। বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে এখন সুন্দরবন থেকে মাছ, কাঁকড়া, মধু আহরণ করেন। কখনও একা, আবার কখনও দল বেঁধে বনে যান।
তিনি বলেন, ‘মনে হয় বন আমাকে ছাড়তে চাইছিল না। তাই ভাগ্যের টানে আবারও আমি বনের পেশায় জড়িয়ে পড়েছি।
‘আমি এখনও পুরোপুরি সুস্থ না। বেশি পরিশ্রম করলে মাথা যন্ত্রণা করে। শরীরে ব্যথা হয়, চোখে ঝাপসা দেখি। বনের মধ্যে মাছ বা কাঁকড়া আহরণের সময়ে নৌকায় বসে কাজ করতে হয়। এই কাজে শরীরে খুব বেশি ব্যথা হয় না। তাই বনজীবী হিসেবে কাজ করতে ভালো লাগে।’
তবে এখন কেউ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও আর খারাপ লাগে না বলে জানিয়েছেন কামাল। তিনি বলেন, ‘এখন আমাকে আর কেউ কালাম বলেন না। সবাই বলেন টাইগার কামাল। নামটাও আমার ভালো লাগে।’