বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কটকট শব্দ নেই, চাহিদা আছে

  •    
  • ১৯ মার্চ, ২০২২ ০৮:২২

মাহবুর বলেন, ‘আগে কটকটি গরম পানি দিয়ে মাখিয়ে তৈরি হতো। সেই কটকটি ঠান্ডা হয়ে এলে খুব শক্ত হতো। খাওয়ার সময় কটকট করে শব্দ হতো। এখন নরম করে তৈরি করা হয়, তাই চাহিদা আগের চেয়ে আরও বেশি হয়েছে।’ 

ময়দার সঙ্গে মেশানো হয় চালের আটা, সেটা গোলানো হয় পানিতে, সঙ্গে মাখানো হয় ডালডা। এরপর সেটির খামির তৈরি করে ছোট ছোট টুকরা করা হয়। টুকরাগুলো ভাজা হয় ফুটন্ত তেলে। এরপর সেগুলো ডোবানো হয় গুড়ের সিরায়। পরে ঠান্ডা হলে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় মুচমুচে সুস্বাদু খাবার ‘কটকটি’।

সুস্বাদু খাবারটি তৈরির এমন বর্ণনা দিচ্ছিলেন বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কটকটি ব্যবসায়ী মাহবুরের স্ত্রী সালমা বেগম। তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে কটকটি তৈরি করে মাজারের পশ্চিমের মাঠে বিক্রি করেন।

উত্তরাঞ্চলের জেলা বগুড়ায় খাবারটি খুব জনপ্রিয়। আশপাশের এলাকায়ও এর চাহিদা রয়েছে। জনপ্রিয় হলেও খাবারটির উৎপত্তির ইতিহাস জানা যায় না। শতবর্ষ ধরে মহাস্থান এলাকায় খাবারটি পাওয়া যায়।

মহাস্থানের মাজার ও প্রাচীন নিদর্শন এলাকায় বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা ফেরার সময় কটকটি কিনতে ভোলেন না। শুধু তা-ই নয়, কোথাও বেড়াতে গেলে কটকটি নিয়ে যাওয়া স্থানীয়দের কাছে অনেকটা রেওয়াজের মতো হয়ে গেছে।

ছোট থেকেই কটকটি তৈরির প্রক্রিয়া জানলেও সালমা বেগম জানান, বিয়ের পর তিনি স্বামীর সঙ্গে পুরোপুরিভাবে কটকটি তৈরিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।

স্বামী মাহবুর রহমান প্রায় সাত বছর কারিগর হিসেবে অন্যের কারখানায় কাজ করেছেন। এরপর সাত বছর আগে নিজেই শুরু করেন কটকটি তৈরির ব্যবসা। মহাস্থানগড়ের ওপর গড়ে তুলেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

মাহবুর বলেন, ‘আগে কটকটি গরম পানি দিয়ে মাখিয়ে তৈরি হতো। সেই কটকটি ঠান্ডা হয়ে এলে খুব শক্ত হতো। খাওয়ার সময় কটকট করে শব্দ হতো। এখন নরম করে তৈরি করা হয়, তাই চাহিদা আগের চেয়ে আরও বেশি হয়েছে।’

তিনি জানান, একসময় গমের আটা দিয়ে তৈরি হতো এই কটকটি, পরে ময়দার সঙ্গে চালের গুঁড়া মিশিয়ে তৈরি শুরু হয়।

বগুড়া ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয় বলে মহাস্থানগড়ে এখন পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ী এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

বাজারটিতে মাসে বা বছরে কী পরিমাণ কটকটি বিক্রি হয় তার কোনো পরিসংখ্যান নেই ব্যবসায়ীদের কাছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, বছরে ছয় মাস (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) মহাস্থানগড়ে পর্যটন মৌসুম ধরা হয়। এই সময়ে গড়ে অন্তত প্রতিদিন ২৫০ মণ কটকটি বিক্রি হয়। অন্য সময়গুলো দৈনিক ১০০ কেজি পরিমাণ বিক্রি হয়ে থাকে। এই হিসাবে মাসে ৬ হাজার মণ, বছরে ৭২ হাজার মণ কটকটি কেনাবেচা হয়।

সম্প্রতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে কটকটি ব্যবসায়ও। দাম বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীদের লাভের অঙ্কে পড়েছে টান।

ব্যবসার অবস্থা নিয়ে মাহবুর বলেন, ‘সবকিছুর দাম বাড়ার কারণে লাভ অনেক কমে গেছে। যে গুড়ের দাম ছিল ৪৫ টাকা; তা হয়েছে ৮৩ টাকা কেজি। ডালডা ১৬ কেজির একটি কার্টন কিনতে লাগে ২ হাজার ৮০০ টাকা। অথচ করোনার আগেই এর দাম ছিল ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। তেল কিনেছি ১৭০ টাকায়। কেনার পর তো আরও দাম বেড়েছে।’

তিনি জানান, এক কেজি কটকটি তৈরি করতে খরচ হয় গড়ে প্রায় ১১০ টাকা। এ হিসাবে প্রতি কেজিতে গড়ে ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত লাভ করা যেত। এখন তা অর্ধেকে নেমে গেছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলেও কটকটির চাহিদা কমেনি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

মহাস্থানগড়ে প্রতি কেজি কটকটি মানভেদে ১২০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি করা হয়। সয়াবিন তেলে ভাজা কটকটি ১২০ টাকা কেজিতে, ডালডায় ১৪০ এবং ঘি মাখা ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়।

ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা জানান, এই কটকটি মাজারের তবারক হিসেবে নেয়া হয়। এ ছাড়া মেহমানদের আপ্যায়নে মুখরোচক কটকটি ব্যবহার করেন স্থানীয়রা।

মহাস্থানগড় উত্তরপাড়ার বাসিন্দা কবিরাজ বাদশা পীর বলেন, ’এই মহাস্থান শাহ মো. সুলতান বলখীর মাজারে অনেক মানুষ প্রতিদিন আসেন। জিয়ারত করেন, মানত করেন। আগতরা এখানে এলে কটকটি কেনেন। এটা মাজারের তবারক হিসেবেই সবাই দেখেন। সব সময় এর বেচাবিক্রি ভালো। রমজানে শুধু বিক্রি কমে যায়।’

গড়ের ওপর জাকারিয়া কটকটির মালিক নুরনবী ইসলাম জানান, দোকানে প্রতিদিন গড়ে ১০০ কেজি কটকটি বিক্রি হয়। শুক্রবার করে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি পর্যন্ত কটকটি বিক্রি হয়ে থাকে।

নুরনবীর সঙ্গে কথা বলার সময় নওগাঁর ধামইরহাট থেকে আসা একদল দর্শনার্থী আসেন কটকটি কিনতে। তারা ১৫ কেজি কটকটি কিনেন নুরনবীর দোকান থেকে।

তাদের একজন আইয়ুব আলী জানান, তারা দুই বাসে প্রায় ১০০ জন মহাস্থানগড়ে বেড়াতে এসেছেন। এসেই নিচে ও ওপরের দোকান ঘুরে প্রায় ৪০ কেজি কটকটি কিনেছেন। এসব কটকটি বাড়ির ও আত্মীয়স্বজনদের জন্য নিয়েছেন।

এই দলের আরেকজন শামীম হোসেন জানান, তাদের গ্রামে মহাস্থানের কটকটি খুব জনপ্রিয়।

মহাস্থান গড়ের নিচের এক দোকানে কথা হয় আরেক দর্শনার্থীর মো. মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে। তার বাড়ি যশোরে। বগুড়ায় থাকেন চাকরির সুবাদে। সুযোগ পেয়ে মহাস্থানগড়ে বেড়াতে এসেছেন।

কটকটি খেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে মাজহারুল বলেন, ‘ঐতিহাসিক এই এলাকায় এসে এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবার কটকটি খাব না তা হয় না। খেয়েছি, আবার নিয়েও যাচ্ছি।’

মহাস্থানগড়ের নিচে বগুড়া-শিবগঞ্জ সড়কের মাজার রোডের দুই পাশে একাধিক দোকান গড়ে উঠেছে। এসব দোকান অনেক পুরোনো। বেশির ভাগই প্রায় ৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে ব্যবসা করছে।

আলাদা এসব দোকানে বড় বড় গামলা ও ড্রামের ট্রেতে কটকটির বিশাল পসরা সাজিয়ে বসেছেন তারা।

সেখানের নাসির কটকটি ভান্ডারের মালিকের ছেলে শহিদুল ইসলাম রঞ্জু এখন ব্যবসা দেখাশোনা করেন। তিনি জানান, কটকটির সুনাম সারা দেশেই ছড়িয়ে আছে। এ জন্য ব্যবসাও প্রসার হচ্ছে। এখানকার প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কারখানা রয়েছে। এ ছাড়া অনেকে শুধু কারখানা গড়ে তুলেছেন। যেখানে নারী শ্রমিকরাই বেশি।

মহাস্থানের পুরোনো দোকানের মধ্যে অন্যতম হামু মামা কটকটি প্যালেস। দোকানের ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির জানান, মহাস্থানে মাজারের ওপর ও নিচের অংশ মিলে প্রায় ২০০ কটকটির দোকান।

তিনি বলেন, ‘এখানকার কটকটি মাজারের তবারক হিসেবে প্রচলিত। প্রায় দেড় শ বছর ধরে কটকটির ব্যবসা হয়ে আসছে এখানে। বিভিন্ন পিকনিক পার্টি থেকে শুরু করে ওরসের লোকজন এখন বেশি। বৈশাখের শেষ বৃহস্পতিবার এখানে সবচেয়ে বেশি কটকটি বিক্রি হয়।’

হুমায়ুন আরও বলেন, ‘এ এলাকায় শুধু কটকটি ব্যবসার সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষ জড়িত। কারিগরদের চাহিদা যেমন বেশি, পারিশ্রমিকও অনেক বেশি।’

বগুড়া জেলা চেম্বার অফ কমার্সের সহসভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, ‘বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী খাবার কটকটি। এর সুনাম শুধু দেশ নয়; বিশ্বেও ছড়িয়েছে। কটকটি ব্যবসার সঙ্গে বহু নারী-পুরুষ জড়িত রয়েছে আমরা জানি, যা আমাদের জেলা বগুড়ার জন্য অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।’

এ বিভাগের আরো খবর