বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শাল্লায় তাণ্ডবকারীরা ঘুরছে ‘বুক চিতিয়ে’

  •    
  • ১৭ মার্চ, ২০২২ ১৭:৪৬

স্থানীয়রা জানান, গ্রামবাসীর আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীদের নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ানো। এই হামলা মামলার সব আসামিই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। হামলায় হাজার লোক অংশ নিলেও পুলিশ অভিযুক্ত করেছে ১৮৬ জনকে।

‘এখনও রাতে ঘুমাতে পারি না। প্রায়ই সেই দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি, লাঠিসোঁটা নিয়ে একদল লোক আমাদের দিকে তেড়ে আসছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করছে। ভয়ে তখন ঘুম ভেঙে যায়।’

বলছিলেন সুধা রানী দাস। সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে বাড়ি সুধার। গত বছরের এই দিনে হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁওয়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল উগ্রবাদী গোষ্ঠী। আরও অনেকের সঙ্গে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছিল সুধা রানীর ঘরও। সেই নারকীয় ঘটনার এক বছর পর এখনও ওই দিনের দুঃসহ স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় এই বৃদ্ধাকে।

সেদিন লুটপাট হয়েছিল মঙ্গলা রানী চৌধুরীর ঘরও। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমিয়েছিলেন মঙ্গলা। সব লুট হয়ে গেছে।

মঙ্গলা বলেন, ‘সর্বস্ব হারিয়ে আমি এখন নিঃস্ব। মেয়ের বিয়ে দেব কী, খেয়ে-পরে বাঁচাই দায় হয়ে উঠেছে। সংসার চালাতে তাই কিশোর ছেলেকে চাকরিতে পাঠিয়েছি।’

নোয়াগাঁওয়ে হামলার এক বছর পর ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন আতঙ্ক আর আফসোসের কথাই শোনা গেছে। গ্রামবাসীর আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীদের নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ানো। এই হামলা মামলার সব আসামিই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। হামলায় হাজার লোক অংশ নিলেও পুলিশ অভিযুক্ত করেছে ১৮৬ জনকে।

উৎসব রূপ নিল বিষাদে

সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। শাল্লায়ও নানা আয়োজনে উদযাপন হচ্ছিল দিনটি। সবখানেই ছিল উৎসবের আমেজ। এর মধ্যে সকালেই নোয়াগাঁওয়ে হামলা চালানো হয়। লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে কয়েক হাজার লোক হামলা চালায় গ্রামটিতে। ভাঙচুর হয় হিন্দুদের ৯০টি ঘর। লুটপাট হয় তাদের সম্পদ। মন্দির-মূর্তিও রক্ষা পায়নি হামলাকারীদের তাণ্ডব থেকে।

নোয়াগাঁওয়ের বাসিন্দা অসীম চক্রবর্তী জানান, হামলার জন্য পরিকল্পিতভাবেই বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে বেছে নেয়া হয়েছিল।

যেভাবে সূত্রপাত

গত বছরের ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। এতে বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সাবেক নেতা মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী ও মামুনুল হক। সমাবেশে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ তুলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন দিরাইয়ের পাশের উপজেলা শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামের যুবক ঝুমন দাস।

১৬ মার্চ ঝুমন ওই স্ট্যাটাস দেয়ার পর থেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে স্থানীয় হেফাজতে ইসলামের অনুসারীরা। মামুনুলের সমালোচনাকে তারা ইসলামের সমালোচনা বলে এলাকায় প্রচায় চালায়। এতে এলাকায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ওই রাতেই পুলিশ ঝুমন দাসকে আটক করে।

পরদিন সকালে হাজারও মানুষ মিছিল নিয়ে হামলা চালায় নোয়াগাঁওয়ে। ঝুমনের এক স্ট্যাটাসের জন্য ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় ৯০টি ঘর।

নোয়াগাঁওয়ের লোকজন জানান, দিরাই উপজেলার নাচনি, চণ্ডীপুর, সরমঙ্গল, সন্তোষপুর ও শাল্লার কাশিপুর, ধনপুরসহ কয়েকটি গ্রামে মসজিদ থেকে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়ানো হয় সেদিন। এরপর এসব গ্রামের মানুষ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নোয়াগাঁওয়ে নারকীয় হামলা চালায়।

তাণ্ডবের সময় ফেসবুকে লাইভ করে হামলাকারীরা। এতে দেখা গেছে, হামলায় নেতৃত্বদানকারীদের অনেকের মাথায় ছিল ‘হেফাজতে ইসলাম’ লেখা বেল্ট।

গ্রামবাসীর অভিযোগ, তাৎক্ষণিক স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে জানানো হলেও তারা ব্যবস্থা নিতে যায়নি।

হামলার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বরখাস্ত করা হয় শাল্লা থানার তৎকালীন ওসিকে। তাৎক্ষণিক বদলি করা হয় দিরাই থানার ওসিকে। তা ছাড়া পুলিশের একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি দায়িত্বে অবহেলার জন্য জেলা পুলিশের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বদলির সুপারিশ করেছিল। পরে তাদের বিরুদ্ধে আর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে হামলায় জড়িতদের বিচার দাবিতে বৃ্হস্পতিবার সকালে মানববন্ধন করে গ্রামবাসী। ছবি: নিউজবাংলা

মামলা, জামিন, অভিযোগপত্র

নোয়াগাঁওয়ে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত হন শহিদুল ইসলাম স্বাধীন নামে স্থানীয় এক ইউপি সদস্য। তিনি যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার নেতৃত্বেই হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। স্বাধীন মেম্বারসহ প্রায় দেড় হাজার জনকে আসামি করে শাল্লা থানায় তিনটি মামলা হয়।

বিপুলসংখ্যক লোককে আসামি করা হলেও পুলিশ এক বছরে গ্রেপ্তার করেছে ৭৫ জনকে। গ্রেপ্তারের কিছুদিন পরই সবাই জামিন পেয়ে যান। প্রধান অভিযুক্ত স্বাধীনও জামিনে আছেন। চলতি বছর ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছিলেন তিনি।

নোয়াগাঁওয়ের বাসিন্দা তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ দাস ও পুলিশের করা দুটি মামলায় সম্প্রতি অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। দুই মামলার অভিযোগপত্রে ১৮৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।আর ঝুমন দাসের মায়ের করা মামলাটি তদন্তের জন্য গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি) দেয়া হয়েছে।

বেশির ভাগ হামলাকারীকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেয়ায় ক্ষুব্ধ নোয়াগাঁও গ্রামবাসী।

গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎচন্দ্র দাস বলেন, ‘আমরা দেড় হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম। পুলিশ মাত্র ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করে। এখন শুনছি ১৮৬ জনকে রেখে সবাইকে মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

‘আমাদের দাবি ছিল দ্রুত বিচার আইনে মামলা হবে। কিন্তু পুলিশ সাধারণ মামলা নিয়েছিল। তবু জীবদ্দশায় হামলাকারীদের বিচার দেখে যেতে চাই।’

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের পরও স্বাধীন ও ফক্কন মিয়ার নির্দেশে বাড়িঘর ভাঙচুর করেছিল হামলাকারীরা। প্রকাশ্যে হামলা হলেও পুলিশ তাদের ধরেনি। বরং মামলা থেকে নাম বাদ দিয়ে দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার বিচার না হলে আমি মরেও শান্তি পাব না।’

মামলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে সুনামগঞ্জ পাবলিক প্রসিকিউটর ড. খায়রুল কবীর রোমেন বলেন, ‘দুই মাস আগে দুটি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ। তবে এখনও বিচারকাজ শুরু হয়নি। অভিযোগপত্র নিয়ে কেউ আপত্তিও জানায়নি।’

তিনি জানান, এসব মামলায় যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল বা জামিন নিতে এসে কারাগারে গিয়েছিল তারা সবাই এখন জামিনে মুক্ত।

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘নোয়াগাঁওয়ে হামলার ঘটনায় মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দেয়া হয়েছে। তদন্তে পুলিশ যাদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে।’

এসপি বলেন, ‘ওই গ্রামের পরিস্থিতিও এখন ভালো। তার পরও গ্রামটির ওপর আমাদের আলাদা নজরদারি রয়েছে। কেউ কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার চেষ্টা করলে কোনো ছাড় নয়।’

ঘরবন্দি ঝুমন

ফেসবুকে স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে ঝুমন দাসকে হামলার আগের দিনই আটক করে পুলিশ। পরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেয় পুলিশ।

পরে ঝুমনের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন শুরু। প্রায় সাত মাস জেল খাটার পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জামিনে মুক্তি পান ঝুমন।

তবে আদালত থেকে শর্ত দেয়া হয়, সুনামগঞ্জের বাইরে যেতে হলে তাকে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। তাই জামিন পেলেও অনেকটা ঘরবন্দি অবস্থায় আছেন ঝুমন।

ঝুমন দাস বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন ঘরের বাইরে কোথাও যেতে চাইলেও পুলিশকে অবহিত করতে হয়। আর বাড়ির পাশের বাজারে গেলেও লোকজন নানা কানঘুষা করে।’

ঝুমন বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমি হিজাব নিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলাম। পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু লিখিনি। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক কানঘুষা শুরু হয়। পরে গ্রামে পুলিশও আসে।’

মানববন্ধনে বিচার দাবি

নোয়াগাঁওয়ে হামলার এক বছর পূর্তিতে বৃ্হস্পতিবার সকালে মানববন্ধন করেছে গ্রামবাসী। গ্রামের পাশে করা মানববন্ধনে সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন ক্ষতিগ্রস্তরা। এ সময় হামলায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের দাবি জানান তারা।

এ বিভাগের আরো খবর