দুই ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাবা ইসমাইল হোসেন। তাদের মৃত্যুর সময় তিনি ঘরে ছিলেন না। কিন্তু নানা ঘটনায় তার মনে সন্দেহ হয়, স্ত্রীর বর্ণনায় কোনো একটা সমস্যা আছে।
অনেক চেষ্টার পর বৃহস্পতিবার দুপুরে ইসমাইলের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের দুর্গাপুরের বাড়ি থেকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায় তার স্ত্রী লিমা আক্তারকে। থানায় নেয়া হয় ইসমাইলকেও।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাপা সিরাপ খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ নিয়ে তোলপাড়ের ৭ দিনের মধ্যে হত্যার কারণ উদঘাটনের কথা জানায় পুলিশ। তারা দাবি করে, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে দুই শিশুকে মিষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে বিষ খাওয়ান তাদের মা লিমা আক্তার।
লিমাকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যার সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বলা হচ্ছে, সেই সফিউল্লা পলাতক।
পুলিশ যে বর্ণনা দিয়েছে, তার সঙ্গে শিশু দুটির বাবা ইসমাইলের বক্তব্যে মেলে পুরোপুরি।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মিলে কাজ করার সময় আমার স্ত্রীর সঙ্গে মিল সর্দার সফিউল্লা বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সফিউল্লা তার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘনিষ্ঠ হন। একপর্যায়ে লিমাকে পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন সফিউল্লা। পরিকল্পনা করেন দুই ছেলেকে হত্যার।
‘এই পরিকল্পনা অনুসারেই লিমা বিষ মেশানো মিষ্টি খাওয়ায় দুই ছেলেকে। পরে ওষুধ খাইয়ে প্রচার করে সিরাপের কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।’
ইসমাইল জানান, ঘটনার দিন তিনি সিলেটে ছিলেন। তাকে ফোন করে জানানো হয় দুই ছেলে অসুস্থ। গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি তিনি থানায় যান। সেখানে গিয়ে দুই ছেলের নিথর দেহ পড়ে থাকার কথা শোনেন। এরপর তাকে বাড়িতে নেয়া হয়।
স্ত্রীর সম্পর্কের বিষয়ে আগে জানতেন না দাবি করে ইসমাইল বলেন, পুলিশ এসে বাড়িতে যে মোবাইল ছিল, সেটা চায়। তিনি লিমাকে সেটি দিতে বলেন, কিন্তু লিমা বলে তার কাছে ফোন নেই; মিলের সর্দার নিয়ে গেছে। তখন প্রথম তার সন্দেহ হয়। বিষয়টি তিনি চেয়ারম্যানকে জানান।
এরপর পুলিশ এসে তার স্ত্রীকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করে।
ইসমাইল বলেন, ‘আমার মনে হয় দুই ছেলে তাদের মাকে সফিউল্লার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিল। এ জন্য প্রথমে তাদের হত্যা করা হয়েছে। পরে হয়তো আমাকেও মেরে ফেলা হতো।’
হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, “আমার ছোট ছোট দুই ছেলেকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। আমার স্ত্রী থানায় আমাকে বলছে, ‘আমাকে বাঁচাও’, কিন্তু আমি তাকে বলছি, আমি তোমার ফাঁসি চাই। আমি সফিউল্লারও ফাঁসি চাই।”
১০ মার্চ আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের ইসমাইল হোসেনের দুই ছেলে সাত বছর বয়সী ইয়াসিন খান ও চার বছর বয়সী মুরসালিন খান নাপা সিরাপ খেয়ে মারা যায় বলে অভিযোগ তোলেন স্বজনরা।
এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় ও জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পুরো জেলায় নাপা সিরাপ বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতি।
যে ফার্মেসি (মা ফার্মেসি) থেকে নাপা সিরাপ কেনার কথা জানিয়েছিল শিশুদের পরিবার, সেটি সিলগালা করে দেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। ওই ফার্মেসি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তা পাঠানো হয় ঢাকায়।
উপজেলা ঔষধ প্রশাসন থেকে জানানো হয়, অনুমোদন ছাড়াই চলছিল মা ফার্মেসি। ঘটনার পর থেকে পলাতক ফার্মেসি মালিক মাঈনুদ্দিন।
পরে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের নাপা সিরাপের একটি ব্যাচ পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে নাপা সিরাপের মানে কোনো সমস্যা না পাওয়ার কথা জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ।