সাধারণত নদীর তীরবর্তী মানুষরা সংগ্রামী হয়। জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে নদী ভাঙন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে তাদের নিয়মিতই সংগ্রাম করতে হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও মধুমতি নদীর পাড়ের মানুষ। তিনিও ছিলেন আজীবন সংগ্রামী। সংগ্রাম-বিপ্লব-প্রতিবাদ ঘিরেই আবর্তিত তার জীবন। কিন্তু তার এই সংগ্রাম নিজে বাঁচার জন্য ছিল না, ছিল জাতির মুক্তির জন্য, বাঙালিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার জন্য।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে যে সংগ্রাম তিনি শুরু করেছিলেন তার পথ পরিক্রমায় খোকা থেকে মজিবর, মজিবর থেকে শেখ মুজিব এবং শেখ মুজিব থেকে পান তার চিরায়ত পরিচিতি ‘বঙ্গবন্ধু’।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক ডাক নাম ছিল খোকা। টুঙ্গিপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান-সায়েরা খাতুন দম্পতির বড় সন্তান ছিলেন তিনি। বাবা-মা আদর করে খোকা বলেই ডাকতেন। বাল্যকালের সহপাঠী, প্রাথমিক এমনকি মাধ্যমিকের সহপাঠীরাও তাকে খোকা নামে চিনতেন। খোকা নামের পরিচিতিতেই তিনি জড়িয়ে পড়েন প্রথমবারের মতো সংগ্রামী জীবনে।
১৯৩৯ সালের কথা। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে যান। তার সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী ডাকবাংলোর দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একদল ছাত্র এসে হঠাৎ তাদের পথ আগলে দাঁড়ায়। ছাত্রদের এমন কাণ্ড দেখে হেডমাস্টার রীতিমত ভড়কে গেলেন। তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘এই তোমরা কী করছ রাস্তা ছেড়ে দাও।’এমন সময় পাতলা-লম্বা ছিপছিপে মাথায় ঘন কালো চুল ব্যাক ব্রাশ করা খোকা (বঙ্গবন্ধু) একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে দাঁড়ালেন। মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি চাও?’ বুকে সাহস নিয়ে নির্ভয়ে খোকা উত্তর দিলেন, ‘আমরা এই স্কুলেরই ছাত্র। স্কুলের ছাদে ফাটল ধরেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সেখান থেকে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে আমাদের বই-খাতা ভিজে যায়। ক্লাস করতে অসুবিধা হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার এ ব্যাপারে বলা হলেও কোনো ফল হয়নি। ছাদ সংস্কারের আর্থিক সাহায্য না দিলে রাস্তা মুক্ত করা হবে না।’
বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা শেখ সায়েরা খাতুনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
কিশোর ছাত্রের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সৎ সাহস আর স্পষ্টবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলতে বাধ্য হলেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা যাও। আমি তোমাদের ছাদ সংস্কারের ব্যবস্থা করছি।’
তিনি অবিলম্বে ছাদ সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিলেন। (সূত্র- অসমাপ্ত আত্মজীবনী)
১৯৭৪ সালে ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত মানুষদের কষ্ট ও দুর্দশার কথা শুনেন ও তাদের পাশে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
অবশ্য তারও আগেই বঙ্গবন্ধুর জেল জীবনের অভিজ্ঞতা হয়। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৩৮ সালে তার সাত দিনের জেল হয়। তাকে নিয়ে লেখা একটি আর্টিকেল থেকে জানা যায়, তার এক মুসলিম বন্ধুকে হিন্দু মহাসভার লোকজন ধরে নিয়ে যায়। বন্ধুদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাকে উদ্ধার করতে গেলে মারামারি হয়। তার বিরুদ্ধে একজন হত্যা চেষ্টার মিথ্যা অভিযোগ করলে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং সাত দিন পর মুক্তি পান।
অসুস্থ হয়ে চার বছর একাডেমিক শিক্ষা থেকে দূরে থাকার সময় খোকার গৃহশিক্ষক ছিলেন আবদুল হামিদ। তখন সাল ১৯৩৭। অসহায় ও দরিদ্র মুসলিম ছেলেমেয়েদের জন্য আবদুল হামিদ গড়ে তুললেন ‘মুসলিম সেবা সমিতি’। একদিন হুট করে মারা যান আবদুল হামিদ। ১৭ বছরের কিশোর শেখ মুজিব ভাবলেন, শিক্ষক নেই বলে সমিতি যদি বন্ধ হয়ে যায়, অনেক ছেলেমেয়ের পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এই জাতির আগামীর মহানেতা। এটিই তার জীবনের প্রথম পদ।
আওয়ামী লীগের ওয়েব পেজে বর্ণিত জাতির জনকের জীবনী থেকে জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। রাজনীতিতে হাতে খড়ির পর কলেজে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় তাকে সহপাঠী ও সতীর্থরা মুজিব ভাই বা শেখ মুজিব নামে ডাকতে শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের মহাসচিব নির্বাচিত হন।
১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার বঙ্গভবনে ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তিতে সই শেষে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে করমর্দন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
৪৭-এ দেশ ভাগের পর দেশে ফিরে যুবলীগের রাজনীতিতে জড়ান। পরে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। এরপর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদক হন।
ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট, ৬২-এর ছাত্র আন্দোলন হয়ে ৬৬ তে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ছয় দফা ঘোষণা করেন। সে সময় মাওলানা হামিদ খান ভাসানী, মুসলিম লীগের সবুর খান, ন্যাপের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তাকে ‘মজিবর’ নামে ডাকতেন।
ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পান। বর্হিবিশ্বে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘শেখ মুজিব’ নামে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাকে শেখ মুজিব নামেই সম্বোধন করা হয়। এই ১৯৬৯ সালেই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের লেখা ‘তিনি যেভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধি পেলেন’ থেকে জানা যায়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারামুক্তির পরদিন অর্থাৎ ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবকে গণসংবর্ধনা দেয়ার আয়োজন করে। আয়োজনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ (ডাকসু) এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তৎকালীন সভাপতি তোফায়েল আহমেদ। তিনি জনতাকে উদ্দেশ্য করে প্রস্তাব রাখেন, শেখ মুজিব বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য জীবন বিপন্ন করেছিলেন। তিনিই বাঙালির প্রকৃত বন্ধু। তাই এখন থেকে তার উপাধি হবে ‘বঙ্গবন্ধু’। লাখ লাখ জনতা হর্ষধ্বনি করে এই প্রস্তাব সমর্থন করে।
টুঙ্গিপাড়ার সেই ছোট্ট খোকা হয়ে ওঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’। আর এ বিশেষণই হয়ে ওঠে তার চিরায়ত রূপ, সর্বজনস্বীকৃত সম্বোধন।