ভোজ্যতেলের পরিশোধন বা উৎপাদন স্তরে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রিতে ৫ শতাংশসহ মোট ২০ শতাংশ ভ্যাট তুলে নেয়ার দুই দিন পরও বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। খুচরা বিক্রেতারা এখন তেল তুলতে চাইছেন কম।
এর মধ্যে আমদানি পর্যায়েও ১০ শতাংশ ভ্যাট তুলে নেয়ার আদেশ জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, যার প্রভাব বাজারে এখনও পড়ার কথা নয়।
ভ্যাট প্রত্যাহার হলেও সরকার ভোজ্যতেলের আমদানি ব্যয় পর্যালোচনা করে নতুন দাম নির্ধারণ বিষয়ে কোনো আলোচনার উদ্যোগ নেই।
আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্ধ্বগতির মধ্যে দেশেও সয়াবিনসহ সব ধরনের তেলের দাম বেড়েছে। গত ১ মার্চ থেকে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আরও ১২ টাকা বাড়াতে ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব সরকার ফিরিয়ে দেয়ার পর বাজারে দেখা যায় অস্বাভাবিক পরিস্থিতি।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করতে থাকেন, মিল থেকে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। মিল মালিকরা অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কারসাজি হচ্ছে।
এর মধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে, গুদামে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করতে থাকে। তবে মিলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার খবর আসেনি গণমাধ্যমে।
এর মধ্যে ভ্যাট ইস্যুর সমাধান হলেও বাজারে গিয়ে তেলের সরবরাহ নিয়ে সংকট কাটতে দেখা যায়নি। পাইকারি পর্যায়ে মিল থেকে সরবরাহ বাড়ার তথ্য পাওয়া গেলেও খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে তেল বিক্রিতে দেখা দিয়েছে অনীহা।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাজার বা গলির মোড়ের দোকানগুলোতে থাকে থাকে সাজানো থাকত এক, দুই ও পাঁচ লিটারের বোতল। আর ভেতরে বা বাইরে গ্যালনে অথবা ড্রামে ড্রামে দেখা মিলত খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের।
এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। সারা দেশে প্রশাসনের অভিযানের কারণে খুচরা বিক্রেতাদের অনেকের মধ্যেই ভয়ভীতি চলে এসেছে। তারা দোকানে এখন আর আগের মতো তেল তুলতে চাইছেন না। অনেকে তেল বিক্রি ছেড়েই দিয়েছেন।
কেউ আবার বাকিতে তেল রাখতেন এবং বিক্রির পর টাকা দিতেন। এখন তেল আনতে হচ্ছে নগদে এবং সেটিও বাড়তি দামে। এ কারণেও অনেকের তেল বিক্রিতে অনীহা চলে এসেছে।
রাজধানীর সেগুনবাগিচা, শান্তিনগর, রামপুরা কাঁচাবাজার ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনন্দিন বাজার দামের চিত্রেও বিষয়টি ফুটে উঠেছে। সংস্থাটির ১৬ মার্চের বাজার চিত্রের প্রতিবেদনে ভোজ্যতেলের অংশে দামের পাশাপাশি উল্লেখ রয়েছে–‘বাজারে পাওয়া যায়নি।’
এসব বাজারের দুই-তিনটি দোকানে বোতলজাত এক-দুই লিটার তেলের দেখা মিললেও ছিল না খোলা তেলের সরবরাহ।
তামিম এন্টারপ্রাইজ, রামপুরার সুমন স্টোর, মেসার্স এবং ওমর ফারুক স্টোরে গিয়ে বোতলজাত কিংবা গ্যালনে বা ড্রামে করে খোলা সয়াবিন ও অয়েল কোনোটিরই দেখা মেলেনি।
রামপুরার তৈয়ব জেনারেল স্টোরের তৈয়ব আলী বলেন, ‘এখন আমরা তেল রাখি না। তেল আনতে হলে নগদ টাকায় আনতে হয়, কিন্তু আমরা সাধারণত বাকিতে এনে বিক্রির পর টাকা দেই। এখন সেটি সম্ভব হচ্ছে না বলে তেল রাখছি না।’
তামিম এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা বলেন, ‘আমরা আপাতত তেল বিক্রি করছি না।’
সুমন স্টোরের একজন কর্মচারী বলেন, ‘তেল বিক্রি করতে গেলেই ঝামেলা। তাই এখন দোকানে তেল রাখা হয় না।’
একই চিত্র পাওয়া গেছে সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোর ও ফারিয়া জেনারেল স্টোরেও।
‘ব্যবসা করে ইজ্জত নষ্ট করবে নাকি’
ব্যবসায়ীদের তেল বিক্রিতে অনীহা সম্পর্কে জানতে চাইলে ভোজ্যতেল পাইকারি ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি গোলাম মাওলা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মানুষ কেন তেল রাখবে? ব্যবসা করে ইজ্জত নষ্ট করবে নাকি?
‘এরই মধ্যে অনেকে তার সম্মান খুইয়েছেন। তেল থাকলেই বলে মজুতদারি। সারা দেশে যা শুরু হয়েছে, তা দেখে অনেকের মধ্যেই ভয়ভীতি চলে এসেছে। এ কারণে তেল বিক্রিতে অনেকের অনীহা থাকতে পারে।
‘তাছাড়া ভোজ্যতেলের এখন একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। এই পরিস্থিতিতে সরবরাহের সব স্তরের বাকিতে তেল বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে নগদ টাকায় তেল কিনে প্রশাসনের জেরার মুখে পড়ার মতো ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।’
ভ্যাট প্রত্যাহারে ভোক্তার কী লাভ
গোলাম মওলা বলেন, ‘ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রভাব কতটা পড়বে-না পড়বে সেটি অপক্ষোর বিষয়। কারণ, সরকার তো এখনও দাম সেটেল করেনি।
‘ভ্যাট কী কমানো হলো, এখন কী হবে এবং বিশ্ববাজারে কী দাম আছে সেটি পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয় এবং মিল মালিকরা সিদ্ধান্ত নেয়ার পর নতুন মালের সরবরাহ শুরু হলে হয়তো ভ্যাটের প্রভাব বোঝা যাবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও আমদানি) এএইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ভ্যাট হ্রাসের সার্বিক পরিস্থিতি পযবেক্ষণ করছি। ট্যারিফ কমিশনকে এ বিষয়ে দাম ফিক্সড করার দায়িত্ব দিয়েছি। তারা পর্যালোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানালে মিলারদের সঙ্গে বসে একটা দাম নির্ধারণ করা হবে।’
ভ্যাট প্রত্যাহারের সুফল এরই মধ্যে বাজারে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘খোলা তেলের দাম বাজারে এখন কমে এসেছে। কিছু দিন আগেও যে তেল লিটারে ১৯৫ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা নেমে এসেছে ১৪৫ টাকায়। আর বোতলজাত তেলের দামটা আমরা ভ্যাট প্রত্যাহার-পরবর্তী এখনও নির্ধারণ করিনি। সেটি ১৬৮ টাকাই বহাল আছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এ প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে জানান, উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট তুলে নেয়া হয়েছে। আমার ধারণা বা আমি বিশ্বাসও করি –দেরিতে হলেও বাজারে এর প্রভাব পড়বে।’