প্রবাসী দালালের সঙ্গে ইতালি যেতে ৩০ লাখ টাকায় চুক্তি করেছিলেন ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইল গ্রামের তিন বন্ধু। এর মধ্যে ২৪ লাখ টাকা তারা ওই দালালের কাছে হস্তান্তরও করেছিলেন।
যাত্রাপথে লিবিয়ায় একটি ঘরে কিছুদিন বন্দি জীবন কাটিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে একটি নৌকায় চড়ে বসেছিলেন। সমুদ্রের ওপারেই ছিল তাদের স্বপ্নের ইতালি। কিন্তু সমুদ্রের বুকেই মৃত্যু হয় দুই বন্ধুর। কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছেন কাইচাইল গ্রামের ইউনুস শেখের ছেলে সামিউল শেখ।
এবার নিউজবাংলাকে দুই বন্ধুর দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর রোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন ২১ বছরের সামিউল। হতভাগ্য সেই দুই বন্ধু ছিলেন কাইচাইল গ্রামের ফারুক মাতুব্বরের ছেলে ১৯ বছরের ফয়সাল ও মাজেদ মিয়ার ছেলে ২২ বছরের নাজমুল।
বেঁচে ফেরা সামিউল দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তৃতীয়। তিনি সরকারি নগরকান্দা মহাবিদ্যালয়ের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু বিদেশে যাত্রা করায় তার পরীক্ষা দেয়া হয়নি।
সামিউল জানান, ইতালি যাওয়ার পথে বাড়ি থেকে বের হয়ে গত বছরের ১৪ নভেম্বর তারা প্রথমে ঢাকা যান। ঢাকায় কাকরাইলের আল-হেলাল বোর্ডিংয়ে তিন দিন অবস্থান করে ১৭ নভেম্বর তারা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দুবাইয়ে যান। পরদিন সেখানে দালাল শওকতের ভাই জুয়েল মাতুব্বরের কাছে পৌঁছান তারা।
১ ডিসেম্বর বিমানে চড়ে লিবিয়ার মাটিতে পা রাখেন তারা। সেখানে প্রায় দুই মাস অবস্থান করার পর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি তাদেরকে লিবিয়ার জোয়ারা ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন অলিদ নামে এক দালাল।
জাহাজের কথা থাকলেও সামিউল, ফয়সাল আর নাজমুলকে ঘাটে নিয়ে অস্ত্রের মুখে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তোলা হয়। ২০ জন ধারণক্ষমতার সেই নৌকাটিতে দুই চালকসহ তারা মোট ৩৭ জন ছিলেন।
প্রায় আট ঘণ্টা চলার পর হঠাৎ ঝোড়ো বাতাসে উল্টে যায় মাঝারি আকারের সেই নৌকাটি। ঢেউয়ের তোড়ে এ সময় দুই চালক আর এক বন্ধু ফয়সালসহ ২৯ জনই ভেসে যান। অবশিষ্ট ৮ জন কোনোক্রমে উল্টে যাওয়া নৌকাটির একপাশ ধরে ভাসছিলেন। এই দলটিতে সামিউলের সঙ্গে তখনও তার বন্ধু নাজমুল ছিলেন। কিন্তু ঢেউয়ের তোড়ে টিকে থাকাই দায়। নৌকা থেকে একবার হাত ছুটে গেলেই ভেসে যেতে হবে নির্ঘাৎ।
এভাবেই ঢেউয়ের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর নাজমুলের হাত ছুটে যায়। নিমেষেই নৌকা থেকে বেশকিছুটা দূরে চলে যান নাজমুল। তাকে বাঁচানোর আর কোনো উপায়ই ছিল না। চোখের সামনেই বন্ধুকে এভাবে ভেসে যেতে দেখেছেন সামিউল।
পরে অবশিষ্ট সাতজন নৌকা ধরে ভাসতে ভাসতে একসময় তিউনিসিয়া সীমান্তে চলে যান।
সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে সামিউল বলেন, ‘তখন আমাদের শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। এভাবে প্রায় ১১ ঘণ্টা ভেসেছিলাম। পরে কিছু দূরে একটি জাহাজ দেখে আমাদের মধ্যে ফারুক নামের একজন একটি লাল গেঞ্জি উঁচু করে নাড়াতে শুরু করেন।
সামিউল জানান, জাহাজের লোকেরা তাদের উদ্ধার করেন। কিন্তু জাহাজে তুলে ওই সাতজনকে তারা নির্যাতন শুরু করেন। লাথি মারতে থাকেন। এ সময় নির্যাতন সইতে না পেরে সেই জাহাজেই রাশেদুল নামে আরেকজনের মৃত্যু হয়।
৩৭ জনের মধ্যে এ সময় বেঁচে থাকা ছয়জন হলেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ গ্রামের ইউসুফ মৃধা, একই জেলার নালিখা গ্রামের ইয়াসিন, বেলাব থানার ফারুক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাকির, মাদারীপুরের ইউনুস আর নগরকান্দার সামিউল শেখ।
সামিউল আরও জানান, ২৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বেঁচে থাকা সেই ছয়জনকে লিবিয়ার জাউইয়া ঘাটে নামিয়ে সেখানকার জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিন দিন রেখে ৩১ জানুয়ারি তাদের খামছাখামছিন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বন্দি থাকতে হয় ১ মাস ২৮ দিন। এই জেলে বেলা ১১টার দিকে ১০০ গ্রামের একটা রুটি এবং রাত ১১টায় আরেকটি রুটি দেয়া হতো। এই রুটির সঙ্গে প্রতিদিন দুই বেলা পানির বোতলের ছিপি মেপে দুই থেকে তিন ছিপি পরিমাণ পানি দেয়া হতো।
একসঙ্গে ইতালি যাত্রা করেছিলেন বাম পাশ থেকে তিন বন্ধু- নাজমুল, সামিউল ও ফয়সাল
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে আসার পর আইওএম-এর পক্ষ থেকে প্রত্যেককে বাড়ি যাওয়ার জন্য ৪ হাজার ৭৮০ টাকা করে দেয়া হয়।
গত ২ মার্চ তারা ঢাকায় পা রেখেছিলেন। পরে বিমানবন্দরের পাশে হজ ক্যাম্পে এক সপ্তাহের কোয়ারেন্টিন শেষে ১০ মার্চ যে যার বাড়িতে চলে যান।
সামিউল বলেন, ‘দালাল রাসেল ও শওকত মাতুব্বর লিবিয়ায় অবস্থান করা নরসিংদীর মনির শীলের কাছে আমাদের বিক্রি করে দেন। পরে মনির শীল লিবিয়ার দালাল অলিদের কাছে আমাদের বিক্রি করেন।’
সামিউল জানান, তাদেরকে ইতালি নিয়ে যেতে যে দালাল চক্রটি কাজ করছিল- তাদের মধ্যে বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন দুজন। আর লিবিয়ায় দুজন। দেশের দুই দালাল হলেন নগরকান্দার কাইচাইল ইউনিয়নের ছোট নাওডুবি গ্রামের হান্নান মাতুব্বরের ছেলে শাহিন মাতুব্বর ও মৃত শামসুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে ইলিয়াস মাতুব্বর। লিবিয়ার দুজন হলেন ছোট নাওডুবি গ্রামের মৃত শামছুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে শওকত মাতুব্বর ও চানু মাতুব্বরের ছেলে রাসেল মাতুব্বর। চার বছর ধরে তারা লিবিয়ায় থাকেন।
এ ঘটনায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি নিহত ফয়সালের বাবা ফারুক মাতুব্বর বাদী ১০ জনকে আসামি করে মানব পাচার আইনে একটি মামলা করেন।
এ ব্যাপারে নগরকান্দা থানার উপপরিদর্শক ও মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পীযূষ কান্তি দে বলেন, ‘মামলার আসামি হান্নান মাতুব্বর, তার ছেলে তুহিন মাতুব্বর ও আসামি কাজল মাতুব্বরকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।’
নগরকান্দা থানার ওসি হাবিল হোসেন বলেন, ‘দেশে ফেরা সামিউল শেখের জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীদের এজাহারের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা এখন কারাগারে। বিচারকাজ প্রক্রিয়াধীন।’