নদীদূষণ ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘কর্ণফুলী নদী, সেখানে যেহেতু ব্যাপকভাবে শিল্পায়ন হচ্ছে, কর্ণফুলী নদী, সাঙ্গু, হালদাসহ যে কটা নদী আছে, এই নদীগুলো যেন কোনোভাবে দূষণ না হয়, এই দূষণের হাত থেকে সেগুলো রক্ষা করতে হবে। কর্ণফুলীর দিকে একটু বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।’
কর্ণফুলী, সাঙ্গু, হালদাসহ চট্টগ্রামের নদী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের শাখা নদীগুলো বাঁচাতে সব ধরনের দূষণ বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণেও নির্দেশ দিয়েছেন সরকারপ্রধান।
চট্টগ্রামের হোটেল র্যাডিসন ব্লুতে বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম ওয়াসা বাস্তবায়িত ‘শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার-২’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশনা দেন।
গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।
ভূমিকম্প ঠেকাতে ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা কমাতে হবে
ভূমিকম্পপ্রবণ বাংলাদেশকে ভূকম্পন থেকে রক্ষায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে যে আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। আমরা যে পানি শোধনাগার করছি বিভিন্ন নদী থেকে, সেটা ভূ-উপরিস্থ পানির থেকে শোধন করা হচ্ছে। তাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর আমাদের নির্ভরতা কমে যাচ্ছে এবং সেটা আমাদের কমাতে হবে।’
কারণ ব্যাখ্যা করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যেহেতু আমাদের দেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা, এসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যাতে না কমে যায় সে জন্য বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া দরকার। যেটা আমাদেরকে আসলে সুরক্ষিত করে।
‘এটা হয়তো আমরা চোখে দেখি না, বুঝতে পারি না। কিন্তু ভৌগোলিক বিষয় যদি আমরা দেখি, তাহলে ভূগর্ভস্থ পানি কিন্তু ভূমিকম্প থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে।’
ঠেকাতে হবে নদীদূষণ
নদীদূষণ ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কর্ণফুলী নদী, সেখানে যেহেতু ব্যাপকভাবে শিল্পায়ন হচ্ছে, তাই কর্ণফুলী নদী, সাঙ্গু, হালদাসহ যে কটা নদী আছে, এই নদীগুলো যেন কোনোভাবে দূষণ না হয়, এই দূষণের হাত থেকে সেগুলো রক্ষা করতে হবে। কর্ণফুলীর দিকে একটু বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।’
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে এসে নদীদূষণ ঠেকানোর বিষয়টি নিয়ে আবারও কথা বলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘আমি আবারও অনুরোধ করব, কর্ণফুলী নদী এটা যেন কোনোভাবে দূষিত না হয়, তার ব্যবস্থাটা আমরা নিয়েছি। এটাকে কার্যকর করা এবং সব সময় অব্যাহতভাবে রাখতে হবে। সাথে সাথে অন্য নদীগুলোও। কারণ আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ছোট ছোট যে শাখা নদীগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলোর দিকেও এখন থেকে সবাইকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সে বিষয়ে আপনারা দৃষ্টি দেবেন।’
‘বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতেই হবে’
যেকোনোভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির পানিটা সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নেবেন বা যখন কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন, প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে একটা ব্যবস্থা আপনাদের নিতে হবে। শুধু পানি শোধন করে যে আমরা দেব তা না, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করাটা এবং সেটা ব্যবহার করা একান্তভাবে দরকার।’
বৃষ্টির পানির সঙ্গে বর্ষাকালে নদীর পানিটাও যেভাবেই হোক সংরক্ষণ করতে হবে বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করার সময় সেটা হাউজিং সোসাইটি হোক বা ইন্ডাস্ট্রি হোক বা কোনো শিল্প এলাকা হোক, যখনই নির্মাণ করবেন প্রতিটি জায়গায় যেন জলাধার থাকে। আর আমাদের বৃষ্টির পানি আর বর্ষাকালের পানিটা যেন আমরা সংরক্ষণ করতে পারি সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।’
আর প্রত্যেকটা শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখন থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে দৃষ্টি দিয়েছে।
চট্টগ্রাম উন্নত হলে, উন্নত হবে দেশ
চট্টগ্রামের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় বিশেষ প্রকল্প নেয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগরীতে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন প্রকল্প প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে আরও পাঁচটি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হবে। যাতে করে আর মানুষের সমস্যা না থাকে।’
বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের গুরুত্ব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়ন করা আমাদের দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। চট্টগ্রামের উন্নয়ন করতে পারলে গোটা বাংলাদেশ উন্নত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে চট্টগ্রামের বিরাট অবদান রয়েছে। তাই সব সময় চট্টগ্রামকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে থাকি।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবদ্দশায় প্রতিবছর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের যে অর্থনীতি, এই অর্থনীতিটা বলতে গেলে এর প্রাণশক্তিটাই হচ্ছে চট্টগ্রাম। এটা আমাদের বাণিজ্য নগরী।’
তিনি বলেন, ‘আর একটি পরিকল্পনা আছে আমার। মীরসরাই যেমন শিল্পনগরী হয়েছে, একেবারে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা। তাহলে চট্টগ্রাম সুরক্ষিত থাকবে, আবার পর্যটনের দিক থেকে সুবিধা হবে। এই চিন্তাটাও আমাদের মাথায় আছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এত চমৎকার একটা এলাকা, এলাকার সৌন্দর্যটা রক্ষা করে, পরিবেশ রক্ষা করে, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা করেই যেন এর সার্বিক উন্নয়ন হয়, সেদিকে বিশেষভাবে আপনারা দৃষ্টি দেবেন।’
১০০ বছর মেয়াদি ডেল্টা প্ল্যানের প্রসঙ্গটি সামনে এনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মনে করি যে আমাদের এই বদ্বীপ অঞ্চল, এই অঞ্চলের প্রতিটা এলাকার মানুষ, একেবারে তৃণমূলের মানুষ, তারাও যেন সুপেয় পানি পেতে পারে এই বিষয়টা মাথায় রেখেই এই ব-দ্বীপের মানুষের জীবনমান উন্নত করার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আমরা নিয়েছি।’
পরিবেশ রক্ষা, পরিশুদ্ধ পানি এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় দিক বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার-২-এর উদ্বোধন
চট্টগ্রাম মহানগর কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প ফেজ-২-এর আওতায় রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় নির্মাণ করা হয়েছে প্রকল্পটি।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চট্টগ্রামবাসীর পানির প্রাপ্যতা আরও সহজ হবে। মানুষ সুপেয় পানি পাবে। যেটা স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বা অন্যান্য কাজের জন্য যথেষ্ট লাভবান হবেন বলে আমি মনে করি।’
নিরাপদ পানি সরবরাহে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের সুফল জনগণ পেলেও, এই সেবা ধরে রাখার ওপর জোর দিতে হবে বলে জানান সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। জনসংখ্যা বাড়ছে, এ কথা মাথায় রেখেই কিন্তু কাজ করতে হবে। যারাই শিল্পকলকারখানা গড়ে তুলবেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে তাদেরকে। কোনোমতেই যেন আমাদের নদীগুলো দূষিত না হয়, এলাকা দূষিত না হয়।’