প্রকৃতি থেকে যে সব খাদ্য-উপাদান পাওয়া যায় তার মধ্যে মধুকে সর্বোত্তম বলা হয়, যাতে রয়েছে নানা ধরনের ওষুধি গুণ। দেশে মধুর সব চেয়ে বড় প্রাকৃতিক আধার সুন্দরবন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও মধু গবেষক আশরাফুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশে সাধারণ দুই ধরনের মধু পাওয়া যায়। একটি হল চাষ করা মধু। অপরটি হল প্রকৃতি থেকে সংরক্ষণ করা মধু।’
তিনি বলেন, ‘মৌমাছি চাষ করে যে মধু পাওয়া যায়, সেটা পুরোপুরি বিশুদ্ধ না।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সরিষা ক্ষেতে কৃষকরা মৌমাছি চাষ করে। সেই ক্ষেতে বাড়তি ফলস ফলানোর জন্য কৃষকরা নানা রকমের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে। সেখান থেকে মৌমাছি মধু আহরণের সময়ে কিছুটা হলেও রাসায়নিক দ্রব্য যুক্ত হয়। তাই একে একেবারে বিশুদ্ধ বলা যায় না।’
‘তবে সুন্দরবন থেকে যে মধু আহরণ করা হয়, তা একেবারে বিশুদ্ধ। সেখানের গাছপালায় কেউ রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে না। ফলে মধুতেও বিষাক্ত কিছু মেশাতে পারে না।’
আন্তর্জাতিক বাজারে মধু বিক্রি করতে হলে সাধারণত তিনটি বিষয়ে নজর রাখতে হয়। স্বাদ, গন্ধ ও রং ভালো হলে মধুর চাহিদা বাড়ে। সুন্দরবনের মধুর এই তিনটি গুণ আছে। তবে আহরণ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি ভালো না হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর গুরুত্ব কম।
ঢাকা শহরে মধুর ব্যবসা করেন সৈয়দ জাহিদুর রহমান। তার প্রতিষ্ঠানের নাম সেইফ হানি। তিনি বলেন, ‘আমরা মধুর মান নির্ধারণ করতে কয়েকটি বিষয় যাচাই করি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মধুতে পানির পরিমান কতটুকু আছে, সেই মাত্রা দেখা।’
তিনি বলেন, ‘‘মধুতে শতকরা ২০ ভাগ বা তার কম পানি থাকলে আমরা ‘এ’ গ্রেডের মধু বলি, যা বেশি দামের, মান ভালো ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। পানির পরিমাণ ২০ থেকে ২৩ ভাগ থাকলে তাকে ‘বি’ গ্রেডের মধু বলি। এটাও অপেক্ষাকৃত ভালো মধু। তবে পানির পরিমান ২৩ ভাগের বেশি হলে সেটাকে আমরা ‘সি’ গ্রেডের মধু বলি, যা বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না।’’
তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন থেকে যে মধু আহরণ করা হয়, তাতে পানির পরিমাণ প্রায় ২৭ ভাগ। এটা বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। পানি হলো মধুর প্রধান শত্রু।’
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সুন্দরবনের মধু চাহিদা থাকলেও গুরুত্ব কম। কারণ এটা সংগ্রহ করা হয় সেই প্রাচীন কালের পদ্ধতিতে। মৌয়ালরা সংরক্ষণের সময়ে মান নিয়ন্ত্রণে কোনো গুরুত্ব দেয় না। ফলে মধুর গ্রহণযোগ্যতাও কমে যায়।
আরও পড়ুন: খাঁটি মধুও কি জমে
‘মৌয়ালরা মধু আহরণের পর অনেক সময়ে ভেজা পাত্রে মধু সংগ্রহ করেন। আবার সুন্দরবন এলাকায় বাতাসে আদ্রতা বেশি। যে কারণে সেখানের মধুতে বেশি পানি পাওয়া যায়।’
আরেক মধু ব্যবসায়ী সাগর হাসনাত বলছেন, ‘ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের সুন্দরবনের মধু আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দাম পায় না। অস্ট্রেলিয়া বা নেপালের বন থেকে আহরণ করা মধুর সুনাম সারা বিশ্বে রয়েছে। আমাদের দেশেও নেপালের মধু প্রতি কেজি ৫ হাজার টাকার বেশি দরে বিক্রি হয়।’
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে মধু বিক্রি করতে হলে সাধারণত তিনটি বিষয়ে নজর রাখতে হয়। স্বাদ, গন্ধ ও রং ভালো হলে মধুর চাহিদা বাড়ে। সুন্দরবনের মধুর এই তিনটি গুণ আছে। তবে আহরণ ও সংরক্ষণ পদ্ধতি ভালো না হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর গুরুত্ব কম।’
যে ভাবে আহরণ করা হয় সুন্দরবনের মধু
সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে হলে প্রথমত বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। এবার ১৫ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বন থেকে মধু সংগ্রহ করতে পারবেন মৌয়ালরা।
সুন্দরবন থেকে ১২ বছর ধরে মধু সংগ্রহ করছেন খুলনার কয়রা উপজেলার মৌয়াল কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণত ৫ থেকে ৮ জন করে নৌকা নিয়ে বনে যাই। মৌচাকের সন্ধানে করতে বনের ভেতর ঘোরাফেরা করি। মৌচাক পেলে প্রথমে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়িয়ে দিই। পরে দা বা চাকু দিয়ে চাকের মধুযুক্ত অংশ কেটে বালতিতে বা এ জাতীয় পাত্রে সংরক্ষণ করি। সেই মধু নৌকায় এনে প্লাস্টিকের ড্রাম বা সিলভারের হাড়িতে সংরক্ষণ করি।’
সংরক্ষণ করা পাত্রগুলো কতটা পরিষ্কার থাকে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এগুলো সাধারণ আমরা নদীর পানি দিয়ে পরিষ্কার করে তাতে মধু সংরক্ষণ করি।’
‘আমরা জানি মধু কখনও নষ্ট হয় না বা এর গুণাগুণ কখনও কমে না। তাই সংরক্ষণের পাত্রের বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিই না।’, যোগ করেন তিনি।
দাম পান না মৌয়ালরা
কামাল হোসেন বলেন, ‘আমার বনে যাওয়ার আগে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মধু বিক্রির শর্তে টাকা নিই। বন থেকে মধু এনে তাদের কাছে বিক্রি করি। সাধারণ মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিসা ফুলের মধু পাওয়া যায়। ব্যবসায়ীরা এগুলি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি দরে কিনে নেন।
‘এ ছাড়া মৌসুমের মাঝামাঝি গরান ও খলিসা ফুলের মিশ্রিত মধু পাওয়া যায়। এই মধু ৩৮০ থেকে ৪২০ প্রতিকেজি বিক্রি করি। মৌসুমের শেষ দিকে অন্যান্য ফুলের মধু পাওয়া যায়, যা ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে ব্যবসায়ীরা কিনে নেন।’
সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের সময়ে মৌয়ালরা সাধারণ মৌচাকের পুরো অংশটি কেটে নেন। ফলে নতুন চাক তৈরি করতে গিয়ে মৌমাছিদের বেশি সময় লেগে যায়। সে কারণে সুন্দরবনে মধুর উৎপাদন তুলনামূলক কম হয়।
তবে খুলনা শহরে বড় বাজারে প্রতি কেজি খলিসা ফুলের মধু বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। ঢাকা শহরে এ মধুর দাম আরও বেশি।
খুলনায় অনলাইনে মধু বিক্রি করেন আরাফাত নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘মৌসুমের সময়ে কয়রার দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মধু সংগ্রহ করি। প্রতি কেজির দাম পড়ে প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। পরে তা বিক্রি করি ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা দরে। কখনও আরও বেশি দামেও বিক্রি করা হয়।’
কতটুকু মধু পাওয়া যায় সুন্দরবনে
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে চার হাজার ১০৬ দশমিক ১৫ কুইন্টাল মধু ও এক হাজার ২৩১ দশমিক ৯৫ কুইন্টাল মোম আহরিত হয়েছে।
খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘চলতি মৌসুমে সুন্দরবন থেকে গত মৌসুমের তুলনায় বেশি মধু আহরণ করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
যে ভাবে সুন্দরবনে মধুর উৎপাদন বাড়ানো যায়
মধু গবেষক আশরাফুল হক বলছেন, ‘সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহের সময়ে মৌয়ালরা সাধারণ মৌচাকের পুরো অংশটি কেটে নেন। ফলে নতুন চাক তৈরি করতে গিয়ে মৌমাছিদের বেশি সময় লেগে যায়। সে কারণে সুন্দরবনে মধুর উৎপাদন তুলনামূলক কম হয়।’
তিনি বলেন, ‘একদল মৌমাছি এক কেজি মৌচাক তৈরি করেতে যে পরিমাণ পরিশ্রম করে, সেই সময়ে তারা প্রায় ২০ কেজি মধু উৎপাদন করতে পারে। মৌচাকের পুরো অংশে মধু থাকে না। একটি অংশে মৌমাছির বাচ্চা ও ডিম থাকে। মৌয়ালরা সাধারণত মধু সংগ্রহের সময়ে ওই বাচ্চা ও ডিম মেরে ফেলে। ফলে মৌ মাছির স্বাভাবিক বংশ বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
‘পুরো মৌচাক না কেটে শুধু মধুর অংশ কাটলে, ওই মৌচাকে আবারও মৌমাছিরা মধু জমা করে। ফলে নতুন চাক তৈরিতে তাদের সময় ব্যয় করতে হয় না।’
মৌয়ালদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিলে তারা মধুর উৎপাদন বাড়াতে পারবে বলেও মনে করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে মৌওয়ালী কালাম হোসেন বলেন, ‘একদল মৌয়াল একটি মৌচাক পেলে সেখানের সবটুকু মধু সংগ্রহ করতে চান। কারণ ওই মৌচাক থেকে তিনি পুনরায় মধু নিতে পারবেন কি না সেই শঙ্কা থাকে। অন্য একজন হয়তো পরবর্তীতে সময়ে সেই মৌচাক থেকে মধু নিবেন। অন্যের জন্য মধু রেখে কী লাভ?
তবে খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘মৌয়ালিদের পাস দেয়ার সময়ে বন কর্মীরা তাদের সতর্ক করেন, যাতে পুরো চাক না কেটে ফেলে।’