লালন স্মরণোৎসবের দ্বিতীয় দিনে তার ভক্ত-অনুসারী ও দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়েছে। কুষ্টিয়ার আখড়াবাড়ির ভেতরে ও বাহিরে যেন পা ফেলার জায়গা নেই। তবে শব-ই-বরাতের কারণে উৎসব দুদিন আগে শুরু করায় অনেক সাধু-বাউল এখনও এসে পৌঁছাননি।
তিনদিনের এ উৎসবের আয়োজকরা মনে করছেন, আজ-কালের মধ্যে চলে আসবেন অন্যরা। তারা বলছেন, আলোচনা, সংগীতানুষ্ঠান ও মেলা এগিয়ে আনা হলেও রেওয়াজ না ভেঙে দৌল পূর্ণিমাতেই শুরু হবে অধিবাস।
বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের আখড়াবাড়িতে স্মরণোৎসবে সাধু বাউলদের দাওয়াত দেয়া লাগেনা, দূর-দূরান্ত থেকে দৌল পূর্ণিমার হিসেব কষে তারা ছুটে আসেন। এ বছর দৌল পূর্ণিমা ও শব-ই-বরাত কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় প্রশাসন দুই দিন এগিয়ে এনেছে উৎসব। তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব শুরু হয়েছে ১৫ মার্চে। তবে এ নিয়ে মনে অসন্তোষ আছে বলছিলেন ফকির শহীদ শাহ।
তিনি বলেন, ‘অনেক সাধু-ফকির-বাউল এসে দেখবেন আমরা চলে যাচ্ছি, যে মিলন মেলা হওয়ার কথা সেটি হবে না।’
শহীদ শাহ’র কথার রেশ দেখা যায় উৎসর শুরুর দিন মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত। কিন্তু বিকেলের পর থেকে আখড়াবাড়িতে লালন ভক্ত-অনুসারীদের ভিড় বাড়তে শুরু করে। আসছেন সাধু-বাউলরাও। দৌল পূর্ণিমার ক্ষণ যত এগিয়ে আসছে ততই আখড়ামুখী হচ্ছেন সাধু-ফকিররা।
হিসেব মতে আগামী বৃহস্পতিবার পূর্ণিমা, আর এদিনই ২০০ বছরের রেওয়াজ ধরে শুরু হবে অধিবাস। পরদিন থাকবে বাল্যসেবা ও পূরণসেবার আয়োজন।
তবে ফকির সালাম শাহ বলেন, ‘প্রশাসন উৎসব দুদিন এগিয়ে আনলেও শেষের দিকে রেওয়াজের আনুষ্ঠানিকতায় লগ্ন মিলিয়ে দিয়েছে তাই সমস্যা হচ্ছে না।’
লালন স্মরণোৎসবের উদ্বোধনের রাতে ভক্ত ও অনুসারীরা লালন দর্শনের গান গেয়ে শোনান। ছবি: নিউজবাংলাএসব নিয়ে অবশ্য চিন্তা নেই প্রবীণ বাউলদের। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকির নহির শাহ লালন দর্শনের চর্চা ও প্রচারে ব্যস্ত থাকতে বলেছেন সাধুদের।
তিনি বলেন, ‘শুদ্ধ মানুষ হতে আত্মসংস্কার দরকার। শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠলে মানবতার প্রকাশ হবে। আর মানবতাবোধ জাগ্রত হলে হানাহানি বন্ধ হবে।’
ফকির ফজল শাহ বলেন, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, এই মানুষে আছে রে মন যারে বলো মানুষ রতন- সাঁইজির এসব বানী হৃদয়ে গেঁথে আছে, এ কারণেই আখড়াবাড়িতে আসি। থাকি। সবার সঙ্গে মত বিনিময় হয়, ভালবাসার সৃষ্টি হয়।’
লালন একাডেমির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সেলিম হক বলেন, ‘সাধারণত পূর্ণিমার ক্ষণ ধরে সাধু-ফকিররা যোগ দেন উৎসবে। ১৭ মার্চ পূর্ণিমা। তাই আজ-কাল ভিড় আরও বাড়বে বলে আশা তার।
সেলিম বলেন, ‘গত দুবছর এ উৎসব করা যায়নি করোনার কারণে। তাই এবার ভিড় বেশিই হওয়াটাই স্বাভাবিক।’
আখড়াবাড়ির বাইরে লালন একাডেমির বিশাল মাঠে লালন মেলাতেও ভিড় বেড়েছে। সন্ধ্যায় লালনের জীবন ও দর্শন নিয়ে আলোচনার পর শুরু হচ্ছে সংগীতানুষ্ঠান।
এর আগে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনদিনের লালন স্মরণোৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। আখড়াবাড়ির মাঠে মূল মঞ্চে আলোচনা সভায় লালন উৎসবের উদ্বোধন করেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ইসমাইল হোসেন। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে লালনের অহিংস মানব মুক্তির শিক্ষা ও আধ্যাত্মবাদ নিয়ে আলোচনা করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহীনুর রহমান ও লালন বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট লালিম হক।
উদ্বোধনের পর ফরিদা পারভীন ও টুনটুন বাউলসহ অনেক বাউল গভীর রাত পর্যন্ত লালন দর্শনের গান গেয়ে শোনান।
বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই তার জীবদ্দশায় প্রতি বছর চৈত্রের দৌল পূর্ণিমা রাতে বাউলদের নিয়ে সাধু সঙ্গ উৎসব করতেন। ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিক তার দেহত্যাগের পরও প্রথমে অনুসারীরা পরে লালন একাডেমি এ উৎসব চালিয়ে আসছে।
এবারের লালন উৎসবে দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার লালন অনুসারী, ভক্ত, বাউল-ফকিররা অংশ নিয়েছেন। ১৭ মার্চ শেষ হবে লালন উৎসব।