বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মাদ্রাসায় বলাৎকার-মৃত্যু: নির্বিকার কওমি বোর্ড বেফাক

  •    
  • ১৬ মার্চ, ২০২২ ০৯:৫৬

কওমি শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মাহফুজুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্র নির্যাতনের কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমাদের কেন্দ্রের কাছে আসেনি।’ মিডিয়ায় এসব ঘটনা আসে। নিয়ন্ত্রক ও তদারক সংস্থা হিসেবে কোনো ব্যবস্থা বা অনুসন্ধান করেন না কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের জেলা পর্যায়ে কমিটি আছে, সেখানে অনেক অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের অধীনে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। জেলা পর্যায়েই এই বিষয়গুলো মীমাংসা হয়ে যায়। কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ এলে বিষয়টি আমরা দেখব।’

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে কওমি মাদ্রাসায় আট বছরের শিশু ইফতেখার মালেকুল মাশফির মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় হলেও এর কিছুই জানা নেই কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়ার (সংক্ষেপে বেফাক) মহাসচিব মাহফুজুল হকের।

এই ঘটনায় ওই মাদ্রাসার তিন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে বেফাক এই বিষয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। সেখানে কী হয়েছে, মাদ্রাসার শিক্ষা পদ্ধতি, কর্মপদ্ধতি বা অন্য কোনো সংকট আছে কি না, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে সেগুলো নিয়ে কোনো কাজ করার ইচ্ছাই তাদের নেই।

কেবল এই ঘটনাটি নয়, নানা সময় মাদ্রাসায় বলাৎকার, শিশুদের অমানবিক পিটুনি, শিশুদের মাদ্রাসা থেকে অভিভাবকদের নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তোলপাড় হলেও প্রতিটি ঘটনাই উপেক্ষা করে আসছে এই বোর্ড।

গত ৪ মার্চ চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে মাদ্রাসা থেকে শিশু ইফতেখার মালিকুল মাশফিকের গলা কাটা মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তিন শিক্ষক গ্রেপ্তারের রেশ কাটতে না কাটতেই ৮ মার্চ আরও এক ছাত্রের মরদেহ পায় পুলিশ।

গত ৮ মার্চ একই জেলার পাঁচলাইশে আলী বিন আবি তালিব (র.) নামে একটি মাদ্রাসার পেছন থেকে উদ্ধার করা হয় মো. আরমান নামের আরেক ছাত্রের মরদেহ।

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি হাফেজি মাদ্রাসায় সম্প্রতি এক ছাত্রকে মারপিটের ভিডিও ভাইরাল হয়। ফাইল ছবি

এ রকম প্রাণহানির তুলনায় কওমি মাদ্রাসা নিয়ে বেশি আলোচনা হয় বলাৎকার ইস্যুতে। কখনও কখনও শিশুদের বেদম পিটুনির ভিডিও আসে সামাজিক মাধ্যমে।

নব্বই দশকে স্কুলেও পিটুনির সমস্যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা দেখা দেয়। এ নিয়ে পরে শিক্ষাবিদ, শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়।

কিন্তু এসব ঘটনায় কওমি মাদ্রাসা দেখভালের দায়িত্বে থাকা বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়া কেবল নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও কোনো পদক্ষেপ নেই।

এই অবস্থায় ১২ থেকে ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর কার্যত কোনো অভিভাবক সংস্থা নেই।

বেফাকের মহাসচিব মাহফুজুর রহমান দাবি করেছেন, তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগই আসেনি।

সরকার আলিয়া মাদ্রাসা দেখভালে বোর্ড গড়ে তুললেও কওমি মাদ্রাসা কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে রেখেছে। এই মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ দাওরাহে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান বা এই শিক্ষায় সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার পরও বিষয়টি পাল্টায়নি।

বলাৎকারের সমস্যা প্রকট

গত ৯ জানুয়ারি বরিশালের একটি কওমি মাদ্রাসার দুই ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয় একই মাদ্রাসার দুই ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করার অভিযোগ উঠেছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।

একই মাসে গাজীপুরের টঙ্গীতে ১১ বছর বয়সী দুই মাদ্রাসার ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অভিযুক্ত ৩৫ বছরের শাহ আলম ওই মাদ্রাসার নূরানী বিভাগের শিক্ষক।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাভারের আশুলিয়ায় এক মাদ্রাসায় ছাত্রকে পেটানোর ভিডিও ভাইরাল হলে অনেক সমালোচনা শুরু হয়। ফাইল ছবি

একই সময়ে ফেনীর দাগনভূঞায় এক মাদ্রাসার ছাত্রকে বলাৎকারের ঘটনায় তিন শিক্ষককে কারাগারে পাঠায় আদালত।

২০২১ সালের ১০ আগস্ট। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জাফরাবাদ ইউনিয়নের ফাতিমানগর এলাকায় জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল নূর মোহাম্মদ আজমী গ্রেপ্তার। অভিযোগ, তিনি ছাত্রকে বলাৎকার করেছেন।

একই বছরের এপ্রিলে একই জেলার কুলিয়ারচর পৌর সদর এলাকার বড়খারচর আদর্শ নূরানী হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ১১ বছর বয়সী এক শিশু বারবার পালিয়ে আসার চেষ্টার পর জানা যায়, মাদ্রাসার এক শিক্ষকের বলাৎকারের শিকার সে। এরপর শিশুটির বাবা মামলা করলে গ্রেপ্তার করা হয় সেই শিক্ষককে।

একই বছরের অক্টোবরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ৯ ও ১০ বছর বয়সী দুটি শিশুকে বলাৎকারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন স্থানীয় একটি কওমি মাদ্রাসার সুপার জাহিদুল ইসলাম।

নানা সময় মাদ্রাসায় বলাৎকার, শিশুদের অমানবিক পিটুনি নিয়ে তোলপাড় হলেও প্রতিটি ঘটনাই উপেক্ষা করে আসছে কওমি মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেফাক। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসা। ফাইল ছবি

মার্চের শেষের দিকে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় এক শিশুকে বলাৎকারের অভিযোগ ওঠার পর মামলা করেন সেই শিশুর বাবা। এই অভিযোগে মাদ্রাসার এক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়।

ছাত্রদের যৌন নির্যাতনের এমন অভিযোগ বিরল নয়। নিয়মিত এই সংবাদগুলো আসে গণমাধ্যমে।

বছর শেষে বিভিন্ন অপরাধ ও নির্যাতন নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিকে তথ্য পরিসংখ্যান প্রকাশ করলেও এই সংখ্যাটি কখনও জানা যায় না, কোনো সংগঠন এটি নিয়ে কাজ না করায়।

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠন বলাৎকার নিয়ে রাজধানীতে তথ্যচিত্র প্রদর্শন করে। ছবি: নিউজবাংলা

তবে ২০২০ সালে ডিসেম্বরের এক মাসে প্রকাশিত সংবাদগুলো সংকলন করে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠন জানতে পারে, ৩০ দিনে মোট ৪০টি বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে দুটি ঘটনায় মারা গেছে দুটি শিশু। একটি শিশু লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে।

যে শিক্ষকরা নির্যাতন করেন তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রথম থেকেই বলে দেয়া উচিত, এ ধরনের ঘটনা যেন সেখানে না ঘটে। কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের শিক্ষকতা বাতিল করা যেতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সে সময় যে পরিসংখ্যান দিয়েছি, সেটা সংবাদমাধ্যম থেকেই নেয়া।’

নির্যাতন নিয়েও সমালোচনা

শুধু বলাৎকার নয়, কথায় কথায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। পড়া না পারলে, ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলে, এক শিক্ষকের ঘরের হিটার আরেক শিক্ষকের কক্ষে রাখলে, দেখতে আসা মায়ের দিকে ছুটে গেলে শিক্ষার্থীদের বেদম পিটুনি দেন। এগুলো গণমাধ্যমেও এসেছে।

গত ২ বছরে বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও গণমাধ্যমে এসেছে। এ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছিল ব্যাপক। বাবা-মা বা স্বজনরাও মামলা করছেন। অনেক জায়গায় মামলা মীমাংসাও হয়েছে। অনেক জায়গায় মামলা মাথায় নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষকরা দিন পার করছেন। শিক্ষকরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। কয়েকটি জায়গায় শিক্ষকদের কারাদণ্ডও হয়েছে।

মাদ্রাসায় বলাৎকারের তথ্যচিত্রের লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। ছবি: নিউজবাংলা

গত বছরের মার্চে বাগেরহাটের রামপালে ১০ বছর বয়সী এক ছাত্রকে হাত বেঁধে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে মারধরের ঘটনা ঘটে।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আশুলিয়ার একটি মাদ্রাসায় দুটি শিশুকে আছড়ে ফেলে উপর্যুপরি বেত্রাঘাতের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তীব্র সমালোচনা হয়েছে। এর মধ্যে না বলে বাড়ি যাওয়ার কারণে বাগেরহাটের একটি মাদ্রাসায় শিশুকে ফ্যানে ঝুলিয়ে পেটানো হয়েছে। ভালুকার একটি মাদ্রাসায় পিটুনিতে একটি ছেলে মারাই গেছে।

যা বলছে কওমি শিক্ষা বোর্ড

কওমি মাদ্রাসার এসব বিষয় নিয়ে বেফাকের মহাপরিচালক মাওলানা মো. জুবায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা। কিন্তু প্রশ্ন শেষ করার আগেই তিনি উল্টো প্রশ্ন করে বসেন। ‘এত দিন পরে কী জানতে চান?’

অতীতে নির্যাতনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের মুরব্বিরা একটি কমিটি করেছিলেন। তাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চান।’

কারা কমিটি করেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বেফাকের সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকের কথা বলেন। তিনি বলেন, উনাদের কাছে জানতে চান। উনারাই ভালো বলতে পারবেন। এ কথা বলেই তিনি ফোন কেঁটে দেন।’

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়ার যাত্রাবাড়ির কার্যালয়। ছবি: সংগৃহীত

পরে মহাসচিব মাহফুজুল হক বলেন, ‘ছাত্র নির্যাতনের কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমাদের কেন্দ্রের কাছে আসেনি।’

মিডিয়ায় এসব ঘটনা আসে। নিয়ন্ত্রক ও তদারক সংস্থা হিসেবে কোনো ব্যবস্থা বা অনুসন্ধান করেন না কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের জেলা পর্যায়ে কমিটি আছে, সেখানে অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের অধীনে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। জেলা পর্যায়েই এই বিষয়গুলো মীমাংসা হয়ে যায়। কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ এলে বিষয়টি আমরা দেখব।’

কওমি নিয়ে মাথাব্যথা নেই মাদ্রাসা বোর্ডের

শিক্ষার্থী নির্যাতন প্রসঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কায়সার আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসা যেহেতু আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেটা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারি না।’

তিনি বলেন, ‘আসলে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত বা শাস্তি দেয়া তো নিষেধ। সাধারণ বোর্ড যেমন সতর্ক করে আমরা ব্যবস্থা নেই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাদ্রাসা বোর্ড কী করছে আমি জানি না। তবে বোর্ডই তো অনুমতি দেয় মাদ্রাসা করার।’

এই শিক্ষাবিদ মনে করেন, ‘যে শিক্ষকরা নির্যাতন করেন, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রথম থেকেই বলে দেয়া উচিত, এ ধরনের ঘটনা যেন সেখানে না ঘটে। কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের শিক্ষকতা বাতিল করা যেতে পারে।

‘এ ছাড়া মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের আচরণ নিয়ে তাদের পলিসি কিংবা বিধিমালায় সেটা স্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থী নির্যাতন অনেক কমে যাবে বলে আমি মনে করি। আর নির্যাতন হলে কী শাস্তি দেয়া হবে, সেটাও সেই বিধিমালায় উল্লেখ থাকা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।’

এ বিভাগের আরো খবর