মধ্য বাড্ডার মুন্সী স্টিল করপোরেশন আগে সপ্তাহে ১০ টন রড বিক্রি করত। বিক্রি কমতে কমতে এখন এক টনে নেমে এসেছে। ক্রেতারা রড না পেয়ে বাড়ি-ঘর নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।
মুন্সী স্টিলের ম্যানেজার সোহেল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মিলমালিকরা আমাদের রড দেয় না। কাঁচামালের সংকটের কথা বলে তারা। ফলে চাহিদা মোতাবেক ক্রেতাদের রড সরবরাহ করতে পারছি না।’
নির্মাণসামগ্রীর অন্যতম উপাদান রডের সাম্প্রতিক এই সংকট শুধু ঢাকায়ই নয়, সারা দেশে এ সমস্যা চলেছে। ছোট-বড় প্রতিটি দোকানেই রডের সংকট দেখা দিয়েছে।
ডিলারদের কাছে রড না থাকায় খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রেতাদের সময়মতো রড দিতে পারছে না। এতে ক্রেতা-ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা লেগে যাচ্ছে। বাজার থেকে রড উধাও হওয়ায় বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণসহ সরকারি উন্নয়নকাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।
রাজধানীর নতুন বাজারের রডের ডিলার আশরাফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা টাকা নিয়ে বসে আছি। মিলমালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলে রড নেই, অপেক্ষা করুন।’
কেন রড দিচ্ছে না– জানতে চাইলে আশরাফ বলেন, ‘মিলমালিকদের দাবি, কাঁচামালের সংকটের কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেছেন, করোনার আগে থেকেই কাঁচামাল সংকট চলছে, যে কারণে রডের দাম আকাশছোঁয়া। ইউক্রেন যুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাজারে রডের কাঁচামালের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। এর প্রভাবে দেশীয় বাজারে রড দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে।
প্রতিদিনই হু-হু করে দাম বাড়ছে নির্মাণশিল্পের অন্যতম এই উপকরণটির। লাগামহীন দামের কারণে রডের গায়ে হাতই দেয়া যায় না।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মঙ্গলবার খুচরা বাজারে প্রতি টন রড বিক্রি হয় ৮৯ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকায়। ক্রেতারা অগ্রিম টাকা দিয়েও রড পাচ্ছেন না। গত বছর এই সময় প্রতি টন রডের দাম ছিল ৫৪ হাজার থেকে ৫৫ হাজার টাকা। সেই রড এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার টাকায়।
এক বছরে রডের দাম বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে এতে বেশি রডের দাম আর কখনই বাড়েনি। দাম বেশি হলেও আগে রড পাওয়া যেত। এখন বেশি দাম দিয়েও রড পাওয়া যাচ্ছে না।
নির্মাণের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় রডের পেছনে। সে জন্য রডের দাম বাড়লে এই শিল্পে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
রডের প্রধান কাঁচামাল পুরোনো লোহালক্কড় বা স্ক্র্যাপ আমদানি করে তা রি-রোলিং মিলে গলিয়ে রড তৈরি করা হয়। ফাইল ছবি
মিলমালিকদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বার্ষিক রডের চাহিদা ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন। এর মধ্যে সরকারি উন্নয়নকাজে ব্যবহার হয় ৬০ শতাংশ। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ বেসরকারি খাতে।
রডের প্রধান কাঁচামাল পুরোনো লোহালক্কড় বা স্ক্র্যাপ আমদানি করে তা রি-রোলিং মিলে গলিয়ে রড তৈরি করা হয়।
৩০ শতাংশ স্ক্র্যাপ সংগ্রহ করা হয় অভ্যন্তরীণভাবে। ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী ও পুরাতন জাহাজ কেটে তা থেকে স্ক্র্যাপ সংগ্রহ করা হয়। আর বাকি ৭০ শতাংশ স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয়।
দেশে রি-রোলিং মিলের সংখ্যা ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১৩০টি। এর মধ্যে বড় আকারের ৫০টি। বাকিগুলো ছোট ও মাঝারি।
সাম্প্রতিক সংকটের কারণ
দেশে রডের প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয় মূলত ইউরোপ ও রাশিয়া থেকে। ইউরোপের দেশ ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার সাম্প্রতিক হামলার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম আরও বেড়ে যায়।
রি-রোলিং মিলের মালিকরা বলেছেন, যুদ্ধের আগে বিশ্ববাজারে প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ছিল ৫৭০ থেকে ৬০০ ডলার। সেই স্ক্র্যাপের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে এখন ৬৫০ থেকে ৭০০ ডলার। হঠাৎ মূল্য বৃদ্ধির কারণে স্ক্র্যাপ সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশীয় বাজারে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ স্টিল মিলস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাসাদুল আলম মাসুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল পুরোনো লোহা, যা স্ক্র্যাপ নামে পরিচিত। এই স্ক্র্যাপ আমদানি করে আমরা কারখানায় বিলেট তৈরি করে রড উৎপাদন করি।’
কিন্তু এই কাঁচামাল নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। কিছু ফ্যাক্টরির কাছে কাঁচামাল আছে। বেশি দাম হলেও রড তৈরি করছে তারা। কিন্তু বেশির ভাগ ফ্যাক্টরি কাঁচামাল সংকটে ভুগছে, যে কারণে রডের সংকট তৈরি হয়েছে।
মাসাদুল আলমের মতে, সংকট যখন শুরু হয়, তখন কাঁচামাল মজুত করার সুযোগ থাকে না। বর্তমানে মিলমালিকদের কাছে তেমন স্টকও নেই। ফলে নিয়মিত এলসি খুলে কাঁচামাল আনতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান নগদ অর্থসংকটে ভুগছে। ফলে তারা এলসি খুলতে পারছে না।
বাজারে রড সংকটের কথা স্বীকার করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সভাপতি প্রকৌশলী সফিকুল হক তালুকদার। তিনি বলেন, ছোট কোনো দোকানে রড নেই। সারা দেশে সব উন্নয়নকাজ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ব্যাহত হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কাজ।
রডের সংকট কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিলমালিকরা বলছে, কাঁচামাল নেই। তবে তিনি মনে করেন, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সত্যিকার কারণ খুঁজে বের করা জরুরি। এ খাতে সরকারের তদারকি ব্যবস্থা থাকা উচিত।
সমাধান কাঁচামাল সহজলভ্য করা
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অস্থির রডের বাজার সহনীয় করতে হলে এর কাঁচামাল স্ক্র্যাপ সহজলভ্য করতে হবে। এ জন্য দুটি পথ খোলা আছে। প্রথমত, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক-কর রেয়াত দেয়া। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ বাজারে কাঁচামালের সরবরাহ বাড়ানো।
বর্তমানে প্রতি টন রডের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ আমদানিতে নির্ধারিত শুল্ক দিতে হয় দেড় হাজার টাকা। এটি কমিয়ে ৫০০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে রি-রোলিং মিলের মালিকরা। এর বাইরে উৎপাদন পর্যায়ে এখন প্রতি টন রডে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ২ হাজার টাকা। এটি কমিয়ে ৫০০ টাকা নির্ধারণের কথা বলছেন মিলমালিকরা।
বর্তমানে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এসব প্রতিষ্ঠানের পুরোনো লোহ সংগ্রহ করে তা দিয়ে স্ক্র্যাপ তৈরি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন, নগর ভবন ও রেলওয়ের কাছে অনেক পুরাতন লোহা আছে, যা দিয়ে স্ক্র্যাপ বানানো যায়।
রি-রোলিং মিলের মালিক মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের পুরোনো লোহা নিলামে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে একদিকে ভালো দাম পাবে, পাশাপাশি কাঁচামালের সংকট অনেকটাই দূর হবে।