ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পরদিন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার ভয়ংকর দুঃস্মৃতির বর্ণনা দিয়েছেন মেহেদি হাসান মোহন।
দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনে পরিবার নিয়ে বসবাস করা মোহন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার সাতগাতী গ্রামের মৃত ডা. মহিউদ্দীনের ছেলে।
মেসেঞ্জারের মাধ্যমে মোহনের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলা প্রতিবেদকের।
তিনি বলেন, ‘কোভেল শহর পেরিয়ে পোল্যান্ড সীমান্তে আসতে একটানা ১৮ ঘণ্টা গাড়িতে ছিলাম, গাড়ি থেকে নামতেই পারিনি। মাত্র ছয় কিলোমিটারের রাস্তা পাড়ি দিতে তিন দিন সময় লেগেছে। সঙ্গে ছিল সন্তান ও স্ত্রী।
‘এর প্রতিক্ষণে মনে হচ্ছিল এই বুঝি বোমা এসে পড়ল। চরম আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছিলাম আমরা। টয়লেট আর গাড়িতে তেল নেয়া ছাড়া কিছুই করতে পারিনি। আসার আগে কিছু কাপড়চোপড় আর শুকনা খাবার নিয়ে আসি, তাই খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকি। ’
তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্তের রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি। বাচ্চাদের চিৎকারে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
‘যানজটের মধ্যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে কেউ কেউ রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করলেও অন্যরা ছিলেন গাড়ির ভেতর। সবাই খুব কাছাকাছি, কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই। শুধু চোখে-মুখে আতঙ্ক। বাড়ি-গাড়ি, সম্পদ সব কিছু কিয়েভে ফেলে রেখে এসেছি। জীবনে বেঁচে থাকাটাকেই পরম ভাগ্য বলে মনে করছি এখন।’
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ছিল মেহেদি হাসান মোহনের মেয়ে লিলিয়া মেহেদির প্রথম জন্মদিন। মেয়ের প্রথম জন্মদিনে কান ফোড়াতে এক জোড়া ডায়মন্ডের দুলও কিনেছিলেন। জন্মদিনের পার্টির আয়োজন চলছিল বাসায়। কিন্তু আগের দিন বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টায় রাশিয়ার হামলায় সব এলোমেলো হয়ে যায়। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন মোহন। ’
জীবন বাঁচাতে মেয়ের জন্য কেনা কানের দুলও নিতে পারেননি তিনি। সব ফেলে শুক্রবার ইউক্রেনের স্থানীয় সময় দুপুর ২টায় গাড়ি নিয়ে পোল্যান্ডের উদ্দেশে সপরিারে বের হয়ে পড়েন মোহন। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু আব্দুল আওয়াল, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান।
তিনি আগে থেকেই শুনেছিলেন পাসপোর্ট ও গাড়ির কাগজপত্র থাকলেই পোল্যান্ডে প্রবেশের অনুমতি মিলছে।
মোহন বলেন, ‘ভয়াবহ যানজট ছিল, যা ভাষায় অবর্ণনীয়। অবশ্য পোল্যান্ড সীমান্তে এলে সেখানকার বাংলাদেশি দূতাবাস খাওয়া-দাওয়াসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। এ ছাড়া ডকুমেন্টস ট্রাভেল পাসসহ নানা ধরনের সহযোগিতা করেছে। নিজের গাড়ি সীমান্তে রেখেই পোল্যান্ড সীমান্তে আগে থেকে রাখা দূতাবাসের গাড়িতে উঠে আবারও পথচলা শুরু হয়।
তিনি আরও বলেন, পোল্যান্ডে দুই দিন থাকার পর সুইজারর্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হন তারা। ৩ মার্চ চেকরিপাবলিক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে পৌঁছান তারা। সেখানে আগে থেকেই বাংলাদেশের দূতাবাসের বাস দাঁড়ানো ছিল। ৫ মার্চ তারা সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন-এ পৌঁছান। সেখানে এক অচেনা শহরে বেঁচে থাকার তাগিদে আবার নতুন করে কিছু করার চেষ্টা করছেন তিনি। সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন মোহন ও তার পরিবার।
এদিকে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রথম দিন থেকেই চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন বাংলাদেশে থাকা মোহনের মা লিলি বেগম ও ভাই-বোনেরা। ছেলে-বৌমা ও নাতনির চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া ছিল না তাদের।
মোহনের মা লিলি বেগম বলেন, শুনেছি মোহন পরিবার নিয়ে সুইজারল্যান্ডে নিরাপদে আছে। এ খবরটুকু পেয়ে এখন একটু ভালো লাগছে। প্রবাসে থাকা ছেলে-বৌমা ও নাতনির জন্য দোয়া চেয়েছেন তিনি।