বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ছবিটি কবেকার, পেছনের গল্প কী

  •    
  • ১৫ মার্চ, ২০২২ ২০:৫১

বোমার আঘাতে মৃত্যুপুরী নাগাসাকিতে ছোট ভাইয়ের মরদেহ পিঠে বয়ে শ্মশানে পৌঁছানো ছেলেটির আলোচিত ছবিটি তোলেন জো ও’ডোনেল। ফেসবুকে ছড়ানো ছবির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে নিউজবাংলা।

ফেসবুকে কিছুদিন ধরে ঘুরছে জাপানি এক শিশুর ছবি। তার পিঠে মৃত আরেক শিশু। ফেসবুকে ছড়ানো বিভিন্ন পোস্টে দাবি করা হয়েছে, মৃত ভাইকে কাঁধে বয়ে নিচ্ছিল শিশুটি।

ছবির বিবরণে লেখা হয়েছে (বানান ও বাক্য অপরিবর্তিত), ‘জাপানে যুদ্ধের সময় এই ছেলেটি তার মৃত ভাইকে কবর দিতে পিঠে নিয়ে যাচ্ছিল। একজন সৈন্য তাকে লক্ষ্য করে এবং তাকে এই মৃত শিশুটিকে ফেলে দিতে বলে যাতে সে ক্লান্ত না হয়। তিনি জবাব দিলেন: সে ভারী নয়, সে আমার ভাই!

‘সৈনিক বুঝতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ল, সেই থেকে এই ছবিটি জাপানে ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।’

এরপর একটি নৈতিকতার আহ্বান জানানো হয়েছে পোস্টটিতে। এতে লেখা হয়েছে, “এটিকে আপনি আপনার কর্তব্য মনে করুন:

“সে ভারী নয়, সে আমার ভাই/সে আমার বোন।”

পোস্টে আরও লেখা হয়েছে, ‘যদি আপনার ছোট ভাই বোন চলার পথে সমাজে পড়ে যায়, তাকে উঠান, যদি সে ক্লান্ত হয়ে যায় যদি তার সমর্থন দুর্বল হয় তা হলে তাকে সাহায্য করুন, আর যদি সে ভুল করেও থাকে তাহলে তাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন। পৃথিবী যদি তাকে পরিত্যাগ করে তবে তাকে আপনার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যান, কারণ সে ভারী নয় সে আপনার ভাই সে আপনার বোন।’

এই ছবির উৎস কোনো পোস্টেই উল্লেখ করা হয়নি। কোনো কোনো পোস্টে ‘কালেক্টেড’ আবার কোথাও লেখা হয়েছে ‘তথ্য বা ছবির সত্যতা যাচাই করা হয়নি, তবে ঘটনা বা গল্পটি সুন্দর’।

ফ্যাক্টচেক

ছবিটি তোলার সময়কাল এবং এর পেছনের ঘটনা যাচাই করেছে নিউজবাংলা।

দেখা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জাপানের নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলার কয়েক দিনের মধ্যেই তোলা হয় ছবিটি। ঐতিহাসিক এই ছবিটি তোলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী জো ও’ডোনেল।

আমেরিকার ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন এজেন্সির হয়ে কাজ করা ও’ডোনেলকে পরমাণু বোমার আঘাতে নাগাসাকি ও হিরোশিমায় ধ্বংসলীলার ছবি তুলতে জাপানে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে টানা সাত মাস তিনি আমেরিকান নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে জাপানে ছবি তোলার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

আর সে সময়েই ঐতিহাসিক এই ছবিটি তোলেন জো ও’ডোনেল। সুনির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া না গেলেও ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরের কোনো এক দিন ছবিটি তোলা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঐতিহাসিক আলোকচিত্রের সংকলনে পরে এটি পরিচিতি পায় ‘দ্য বয় স্ট্যান্ডিং বাই দ্য ক্রেমেটরি’ বা ‘শ্মশানের সামনে দাঁড়ানো বালক’ হিসেবে।

জাপানের নাগাসাকিতে আমেরিকার পরমাণু বোমা আঘাত হানে ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট। এতে প্রাণ হারান ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় গোটা শহর। তেজস্ক্রিয়তার কারণে বোমা বিস্ফোরণের পরেও দীর্ঘদিন ধরে শহরে চলে মৃত্যুর মিছিল।

বোমার আঘাতে মৃত্যুপুরী নাগাসাকিতে ছোট ভাইয়ের মরদেহ পিঠে বয়ে শ্মশানে পৌঁছানো ছেলেটির আলোচিত ছবিটি তোলেন জো ও’ডোনেল। ফেসবুকে ছড়ানো ছবির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে নিউজবাংলা।

তবে ফেসবুক পোস্টে শিশুটির সঙ্গে কথিত সৈন্যের কথোপকথনের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

আমেরিকান আলোকচিত্রী জো ও’ডোনেল

যুদ্ধের বহু বছর পর জাপানের একটি সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আলোকচিত্রটির পেছনের গল্প শুনিয়েছিলেন জো ও’ডোনেল। ওয়ার্ল্ডওয়ারটুরেকস ডটকম ওয়েবসাইটে সেই গল্পের কিছুটা তুলে ধরা হয়েছে।

ও’ডোনেল সাক্ষাৎকারে বলেন, জাপানে সেই দিনগুলিতে, ‘আমি ১০ বছর বয়সী একটি ছেলেকে হেঁটে আসতে দেখলাম। সে পিঠে একটি শিশুকে বয়ে আনছিল।

সেই সময়ে জাপানে আমরা বাচ্চাদের প্রায়ই দেখতাম ছোট ভাই বা বোনকে পিঠে ঝুলিয়ে খেলছে, তবে এই ছেলেটি স্পষ্টতই ছিল আলাদা।

আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, কোনো গুরুতর কারণে সে এ জায়গায় এসেছে। তার পায়ে কোনো জুতা ছিল না।

তার মুখ ছিল শক্ত।

পিঠে ঝোলানো শিশুটির ছোট্ট মাথাটি এমনভাবে পেছন হেলে ছিল, যেন সে ঘুমিয়ে আছে। ছেলেটি আসার পর পাঁচ-দশ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।

সাদা মাস্ক পরা লোকজন তার কাছে গেল এবং পিঠে শিশুটিকে বেঁধে রাখার দড়িটি চুপচাপ খুলতে শুরু করল।

তখনই দেখলাম বাচ্চাটা মারা গেছে।

লোকজন এরপর মৃতদেহটি বয়ে নিয়ে শ্মশানের আগুনে পুড়িয়ে দেয়।

ছেলেটি কোনো নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে আগুনের শিখা দেখছিল। সে তার নিচের ঠোঁট জোরে কামড়ে ধরায় রক্ত বেরিয়ে আসছিল।

সূর্য অস্ত যাওয়ার মতো ধীরে ধীরে আগুনের শিখা কমে আসে। এরপর ছেলেটা ঘুরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ চলে যায়।

আমেরিকান সরকারের গোপনীয়তার নীতির কারণে নাগাসাকিতে তোলা ও’ডোনেলের আলোকচিত্রগুলো দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। তবে ছবিগুলোর কপি তিনি নিজের বাড়িতে একটি ট্রাঙ্কে লুকিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৮৯ সালে সেগুলোর প্রথম প্রদর্শনী হয়। এ ছাড়া ছবিগুলো নিয়ে ১৯৯৫ সালে জাপানে প্রকাশিত হয় ‘জাপান ১৯৪৫, ইমেজেজ ফ্রম দ্য ট্রাঙ্ক’ শিরোনামের বই। এরপরেই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় আলোকচিত্রগুলো।

জো ও’ডোনেলের তোলা মূল ছবিটি

ছবির সেই শিশুটি কোথায়

জো ও’ডোনেলের আলোকচিত্রের বালকটির পরিচয় বের করতে জাপানের অনেকেই চেষ্টা করেছেন।

নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলার সময় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের একজন ইয়োশিতোশি ফুকাহোরি। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছবির ছেলেটিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন।

তবে নাগাসাকি ট্র্যাজেডি থেকে রক্ষা পাওয়া আরেক ব্যক্তি মাসানোরি মুরাওকার দাবি, আলোকচিত্রের ছেলেটি তার স্কুলেই পড়ত।

ছেলেটিকে তার শৈশবের খেলার সাথি বলেও দাবি করছেন মুরাওকা, তবে নামটি তার স্মরণে নেই।

নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা আঘাতের সময় ১১ বছর বয়স ছিল মুরাওকার। তার দাবি, মৃত ভাইকে পিঠে ঝুলিয়ে যাওয়ার সময় ১০ বছরের ছেলেটির সঙ্গে তার কথাও হয়েছিল। ছেলেটি বলেছিল, তার মা ওখানে তখন নেই। ছেলেটিকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টায় মুরাওকা অবশ্য সফল হননি।

আলোকচিত্রের ছেলেটিকে খোঁজার প্রচেষ্টা নিয়ে জাপান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (এনএইচকে) প্রযোজিত একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম হয়েছে। সার্চিং ফর দ্য স্ট্যান্ডিং বয় অফ নাগাসাকি নামের ৫০ মিনিটের এই ফিল্ম মুক্তি পায় ২০২০ সালের ৮ আগস্ট। চলচ্চিত্রটি আমেরিকান পাবলিক টেলিভিশনের মাধ্যমে গত বছর আমেরিকাতেও মুক্তি পায়।

আর ঐতিহাসিক আলোকচিত্র যিনি তোলেন, সেই জো ও’ডোনেল মারা যান ২০০৭ সালের ৯ আগস্ট।

এ বিভাগের আরো খবর