পবিত্র আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় পুরান ঢাকার হোসনি দালানে বোমা হামলা মামলার তদন্তে ব্যাপক গাফিলতি হয়েছে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন বিচারক মজিবুর রহমান।
মামলাটির তদন্ত করেন ডিবি দক্ষিণের পুলিশ পরিদর্শক শফিউদ্দিন শেখ। তিনি তদন্তে মারাত্মক সব ভুল করেছেন এবং দায়িত্বে অবহেলা করেছেন বলে জানান বিচারক।
পর্যবেক্ষণে ঢাকার সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বলেন, শুধু আসামি বাড়াতে তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই ৬ জনকে আসামির তালিকায় যুক্ত করেছেন। তার গাফিলতির কারণেই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও হামলাকারীরা আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছে।
মঙ্গলবার ঢাকার সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান হোসনি দালানে বোমা হামলা মামলার রায় পড়ে শোনান। রায়ে ৮ আসামির মধ্যে ২ জনকে সাজা দেয়া হয়। ৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তাদের খালাস দেয়া হয়।
রায় ঘোষণার আগে মামলাটি নিয়ে পর্যবেক্ষণে তদন্ত কর্মকর্তার বিষয়ে উপরোক্ত মন্তব্য করেন বিচারক।
বিচারক মজিবুর রহমান পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, ‘আসামি কবীর হোসেন ও আরমান তাদের দোষ স্বীকার করে জবানবন্দিতে হোসনি দালানে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় চাঁন মিয়া, ওমর ফারুক, হাফেজ আহসানউল্লাহ মাহমুদ এবং শাহজালাল মিয়া জড়িত মর্মে কোনো বক্তব্য দেননি। কোনো সাক্ষী এ চার আসামির নাম উল্লেখ করেননি।
‘তাদের কাছ থেকে আলামত উদ্ধারের কোনো অভিযোগ নেই। তারা ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে সাক্ষ্য উপস্থাপনে প্রসিকিউশন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এই আসামিরা কীভাবে হোসনি দালানে বোমা হামলায় জড়িত তার ব্যাখ্যা তদন্তকারী পুলিশ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেননি। শুধুমাত্র আসামির সংখ্যা বাড়ানোর জন্যই অযথা তদন্তকারী কর্মকর্তা এই চারজনকে এ মামলায় বিচারের জন্য সোপর্দ করেন। কাজেই তারা হামলায় অংশগ্রহণ করেছে বা সহায়তা করার অভিযোগ প্রমাণ করতে প্রসিকিউশন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কবীর হোসেন ও আরমানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায়, হোসনি দালানে বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা ছিল আলবানী এবং নোমান। আরমানের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হোসনি দালানে বোমা হামলা করেছে রানা ওরফে মুসায়েব এবং হিরন।
‘মামলার রেকর্ডে দেখা যায়, আসামি জাহিদ হাসান, রানা এবং মাসুদ হাসান রানা ঘটনার সময়ে শিশু ছিল, ফলে বিচারের জন্য সন্ত্রাস বিরোধী আইনে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক অভিযোগপত্র বিচারের জন্য শিশু আদালতে জমা দেয়া হয়।’
বিচারক বলেন, ‘তদন্তকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, হিরন, আলবানী ওরফে হুজ্জা ও আব্দুল্লাহ ওরফে আলাউদ্দিনের নাম পাওয়া গেলেও এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই তারা বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন। তাই তাদের নাম পুলিশ প্রতিবেদনে অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা শফিউদ্দিন শেখ কার কাছ থেকে, কিংবা কোথায়, কীভাবে জানতে পেরেছেন যে হিরন, আলবানী ও আব্দুল্লাহ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে সে বিষয়ে পুলিশ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনি।
‘হিরন এবং আলবানীর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার সমর্থনে কোনো কাগজপত্রও এ মামলায় জমা দেয়া হয়নি। হোসনি দালানে গ্রেনেড হামলার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী নোমানকে কেন আসামি হিসেবে মামলায় অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি সে বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা কোনো বক্তব্য দেয়নি।’
পর্যবেক্ষণে বিচারক মজিবুর রহমান আরও বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা শফিউদ্দিন শেখ কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই চাঁন মিয়া, ওমর ফারুক, হাফেজ আহসান উল্লাহ এবং শাহজালাল মিয়াকে অযথাই আসামি হিসেবে বিচারের জন্য সোপর্দ করেছেন। পূর্ণ তদন্ত না করার ফলে ঘটনার হোতা ও মূল পরিকল্পনাকারীরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আসামির সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অযথাই ছয় জনকে আটক করে ট্রাইব্যুনালের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে।’
২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে হোসেনি দালান এলাকায় তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায়। এতে দুজন নিহত ও শতাধিক আহত হন।
মামলাটিতে মঙ্গলবার আদালত আরমান ওরফে মনিরকে ১০ বছরের এবং কবির হোসাইনকে সাত বছরের দণ্ড দেয়। দুই আসামির প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ডের আদেশ দেয়।
মামলায় খালাস পান আবু সাঈদ ওরফে সালমান, রুবেল ইসলাম ওরফে সুমন ওরফে সজীব, চান মিয়া, ওমর ফারুক, হাফেজ আহসান উল্লাহ মাহমুদ ও শাহজালাল।