উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের পর ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এতদিন আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট থাকলেও সেটি এখন ৫ শতাংশ করা হচ্ছে বলে মঙ্গলবার নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা গাজী তৌহিদুল ইসলাম সিজার।
তিনি জানান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এ বিষয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে।
আগের দিন উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে সরকার।
তবে এই সিদ্ধান্তে রান্নার উপকরণটির বাজার স্বাভাবিক হবে না বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করে আসছিলেন। তাদের যুক্তি, ভ্যাটের সিংগভাগ দিতে হয় আমদানি পর্যায়ে। সেটি প্রত্যাহার না হলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির চাপ সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
এই পরিস্থিতিতে সোমবার রাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট তুলে নেয়ার প্রস্তাব করা হয়। চিঠির অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সরকারের নানা দপ্তরে দেয়া হয়।
নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতির মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে আলোচনা সবচেয়ে বেশি। গত এক বছরে এই তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ৩৪ টাকা। গত ৮ ফেব্রুয়ারি বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে সর্বোচ্চ ১৬৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
তবে গত ১ মার্চ থেকে দাম লিটারে আরও ১২ টাকা বাড়াতে বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো সরকারকে প্রস্তাব দেয়। তাদের যুক্তি, লিটারে দাম ১৬৮ টাকা নির্ধারণের সময় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে মূল্যে তেল আনতে হতো, এখন দাম তার চেয়ে আরও বেশি।
তবে সরকার দাম না বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতির চাপ রোজার মাসে সয়ে নিতে ব্যবসায়ীদেরকে পরামর্শ দেন বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি।
এই অবস্থায় ১ মার্চ থেকে বাজারে দেখা দেয় সরবরাহের ঘাটতি। ক্রেতারা অভিযোগ করছেন, তারা তেল কিনতে গেলে সঙ্গে অন্য পণ্য নেয়ার শর্ত দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বিক্রেতারা বলছেন, কোম্পানি তাদেরকে তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য নিতে বাধ্য করছে। নইলে তেল দিচ্ছে না। তবে কোম্পানি দাবি করছে, তাদের সরবরাহ ঠিক আছে, পাইকারি ব্যবসায়ীরা মজুত করছেন।
এই পরিস্থিতিতে জেলায় জেলায় বাজারে বাজারে চলছে অভিযান। এসব অভিযানে তেল মজুত করে তা বিক্রি না করার অভিযোগের প্রমাণ মিলছে। এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও তেল রেখে দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। ভারতে পাচারের সময় ধরা পড়েছে চালান।
এর মধ্যে বাজারে সরবরাহ নিয়ে অস্থিতরা তৈরি হলে সরকার জুন পর্যন্ত তেলের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ভ্যাট প্রত্যাহার হলেও এর কোনো প্রভাব মিলছে না বাজারে।
সোমবার উৎপাদন ও বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাট প্রত্যাহারের আদেশ দেয়ার পর বাজারে এর খুব একটা প্রভাব পড়বে না বলে সাফ জানিয়ে দেন সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা।
‘তেলের কাঁচামালের আন্তর্জাতিক বাজার এখন ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে এক লিটার ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে ২০ টাকা ভ্যাট পড়ছে। এখন এনবিআর উৎপাদনপর্যায়ে যে ভ্যাট তুলে নিয়েছে, তাতে প্রতি লিটার তেলে দাম কমবে মাত্র তিন টাকা।
‘অপরদিকে বিক্রি পর্যায়ের ভ্যাটও তুলে নিয়েছে। এর সুবিধা খোলাবাজারের ভোক্তারা হয়ত পাবে। তবে স্বপ্ন, আগোরা ও মীনা বাজারের মতো বিভিন্ন চেইনশপ থেকে তেল কিনতে গেলে কিন্তু ভোক্তাদের সেই ভ্যাটের মওকুফ সুবিধা মিলবে না। বর্তমানে চেইনশপের কেনাকাটায় শতকরা পাঁচ টাকা ভ্যাট দিতে হচ্ছে।’
এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এনবিআরকে চিঠি পাঠিয়ে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট তুলে নেয়ার অনুরোধ করা হয়।
তবে এই ভ্যাট প্রত্যাহারে বাজারে দাম কমবে কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। এর কারণ আন্তর্জাতিক বাজার ক্রমেই চড়ছে।
সিটি গ্রুপের বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘বর্তমানে লিটারে ১৬৮ টাকায় যে তেল আমরা বিক্রি করছি, সেটির আন্তর্জাতিক বাজার ছিল টনপ্রতি এক হাজার ৩০০ ডলার। আমরা প্রতি লিটার তেলের দাম ১৮০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিলাম, তার আন্তর্জাতিক বাজারে গড় মূল্য ছিল এক হাজার ৪২০ ডলারের। এখন ওই তেলের দাম ১ হাজার ৯০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তেল আমদানি করে জাহাজ ভাড়া দিয়ে দেশে আনার পর আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট পরিশোধ করে কী দাম পড়তে পারে সেটি একবার ভেবে দেখুন।’
বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের বাজার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর।
দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসে চাহিদা প্রায় ২.৫ লাখ থেকে তিন লাখ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, স্থানীয় উৎপাদন প্রায় ২ লাখ টন। বাকি প্রায় ১৮ লাখ টন আমদানি করে ভোক্তার চাহিদা পুরণ করতে হয়।