ভোজ্যতেলের ভ্যাট কেবল উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে প্রত্যাহার হলে ভোক্তারা আদৌ কোনো সুফল পাবে কি না, এই প্রশ্নের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাইছে আমদানি পর্যায়েও যেন কোনো ভ্যাট না থাকে।
উৎপাদন এবং বিক্রি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের আদেশের পর সোমবার মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে। এর অনুলিপি দেয়া হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছেও।
ভোজ্যতেলের সরবরাহ বৃদ্ধি ও দাম ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে রোববার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত ছিল কাঁচামাল আমদানি, পরিশোধন বা উৎপাদন এবং খুচরা বিক্রি-এই তিন স্তরেই ভ্যাট থাকবে না।
তবে পরদিন এনবিআর যে আদেশ জারি করে, তাতে কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ের বিষয়টি উল্লেখ ছিল না।
এ বিষয়ে ভোজ্যতেলের অন্যতম আমদানিকারক, পরিশোধনকারী তীর ব্র্যান্ডের তেল সরবরাহকারী কোম্পানি সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রত্যাহার করেছে স্থানীয় উৎপাদন ও বিক্রি পর্যায়ের ভ্যাট। ভ্যাট প্রত্যাহারের এমন সিদ্ধান্তে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমার ক্ষেত্রে খুব একটা সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।’
তিনি বলেন, ‘তেলের কাঁচামালের আন্তর্জাতিক বাজার এখন ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে এক লিটার ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে ২০ টাকা ভ্যাট পড়ছে। এখন এনবিআর উৎপাদনপর্যায়ে যে ভ্যাট তুলে নিয়েছে, তাতে প্রতি লিটার তেলে দাম কমবে মাত্র তিন টাকা।
‘অপরদিকে বিক্রি পর্যায়ের ভ্যাটও তুলে নিয়েছে। এর সুবিধা খোলাবাজারের ভোক্তারা হয়ত পাবে। তবে স্বপ্ন, আগোরা ও মীনা বাজারের মতো বিভিন্ন চেইনশপ থেকে তেল কিনতে গেলে কিন্তু ভোক্তাদের সেই ভ্যাটের মওকুফ সুবিধা মিলবে না। বর্তমানে চেইনশপের কেনাকাটায় শতকরা পাঁচ টাকা ভ্যাট দিতে হচ্ছে।’
তেল বাজারজাতকরণ কোম্পানির এই কর্মকর্তার েউদ্বেগের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভাবনারও মিল আছে।
চিঠিতে মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে দেশীয় বাজারেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভোজ্যতেলের (সয়াবিন ও পাম তেল) দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘আসন্ন পবিত্র রমজানে এতো বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে হলে সরবরাহ চেইন স্থিতিশীল রাখা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যমান মূল্যে আমদানিকৃত অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামতেল স্থানীয় মিলে পরিশোধিত হয়ে বাজারে প্রবেশ করলে প্রতি লিটার সয়াবিন ও পামতেলের মূল্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
‘এ পরিস্থিতিতে ১৩ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পবিত্র রমজান মাস ও ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনা করে আমদানিকৃত অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামতেলের উপরও প্রযোজ্য মূল্য সংযোজন করও (ভ্যাট) সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। এর মধ্যে রমজান মাসে চাহিদা প্রায় ২.৫ লাখ থেকে তিন লাখ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, স্থানীয় উৎপাদন প্রায় ২ লাখ টন। বাকি প্রায় ১৮ লাখ টন আমদানি করে ভোক্তার চাহিদা পুরণ করতে হয়।
পণ্যমুল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে তুমুল আলোচনা ভোজ্যতেল নিয়ে। গত এক বছরে সয়াবিন তেলের নাম বেড়েছে লিটারে ৩৪ টাকা। সেটি ১ মার্চ থেকে আরও ১২ টাকা বাড়াতে প্রস্তাব দিয়েছিল ভোজ্য তেল পরিবেশকরা। তবে সরকার সেই দাবি মেনে না নেয়ার পর বাজারে সরবরাহে দেখা দেয় ঘাটতি।
ক্রেতারা অভিযোগ করছেন, তারা তেল কিনতে গেলে সঙ্গে অন্য পণ্য নেয়ার শর্ত দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বিক্রেতারা বলছেন, কোম্পানি তাদেরকে তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য নিতে বাধ্য করছে। নইলে তেল দিচ্ছে না। তবে কোম্পানি দাবি করছে, তাদের সরবরাহ ঠিক আছে, পাইকারি ব্যবসায়ীরা মজুত করছেন।
এই পরিস্থিতিতে জেলায় জেলায় বাজারে বাজারে চলছে অভিযান। এসব অভিযানে তেল মজুত করে তা বিক্রি না করার অভিযোগের প্রমাণ মিলছে। এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও তেল রেখে দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। ভারতে পাচারের সময় ধরা পড়েছে চালান।
সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘বর্তমানে লিটারে ১৬৮ টাকায় যে তেল আমরা বিক্রি করছি, সেটির আন্তর্জাতিক বাজার ছিল টনপ্রতি এক হাজার ৩০০ ডলার। আমরা প্রতি লিটার তেলের দাম ১৮০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিলাম, তার আন্তর্জাতিক বাজারে গড় মূল্য ছিল এক হাজার ৪২০ ডলারের। এখন ওই তেলের দাম ১ হাজার ৯০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তেল আমদানি করে জাহাজ ভাড়া দিয়ে দেশে আনার পর আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট পরিশোধ করে কী দাম পড়তে পারে সেটি একবার ভেবে দেখুন।’