চোখের সামনেই শীতলক্ষ্যার রং বদলাতে দেখছেন রুস্তম আলী। একসময় যে নদীর পানি দেখেছেন ধবধবে সাদা আর স্বচ্ছ, সেটি এখন কালো আর দুর্গন্ধময়।
নৌকার বৈঠা বাইতে গিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। তবে যারা তার উপার্জনের পথে বাধা হয়েছেন তাদের অভিশাপ দেন।
রুস্তমের নৌকায় চড়ে আলাপের একপর্যায়ে বলেন, ‘আহা রে, কত্ত সুন্দর আছিল শীতলক্ষ্যা নদীডা। আগে নৌকা চালাইয়া ক্লান্ত হইলে হাতে নিয়া নদীর পানি খাইতাম। ভোর হইলে দেখতাম মাছ ধরতে কত্ত মাইনষের ভিড়। হেই নদীডারে শেষ হইরা দিছে কারখানাগুলি। অহন কালা পানিতে পচা গন্ধ আহে।’
কারখানার বর্জ্য পানিতে মেশা দেখাতে নিয়ে যান নদীর পাড়ে। সেখানে দেখা যায়, মোটা পাইপে রঙিন পানি এসে পড়ছে শীতলক্ষ্যায়। দূষিত নদীতে বাড়ছে দূষণের মাত্রা।
নারায়ণগঞ্জের ৫ নম্বর খেয়াঘাটের মাঝি রুস্তম আলী। ছবি: নিউজবাংলা
নারায়ণগঞ্জের ৫ নম্বর খেয়াঘাটের মাঝি রুস্তম আলী। তিনি এই ঘাটে ১৯ বছর ধরে নৌকা বেয়েছেন। এখন হাতে বাওয়া নৌকায় রোজগার বেশি না হওয়ায় চালাতে শুরু করেছেন ট্রলার।
আগে অনেকেই শখের বশে নদীতে নৌকায় ঘুরতেন। এখন প্রয়োজন ছাড়া কেউ নদী পার হন না।
শুধু মাঝিরাই নন, শীতলক্ষ্যায় দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জেলা, শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষ।
আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সংগঠনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন আহম্মেদ নিউজবাংলাকে জানান, শীতলক্ষ্যা নদীকে ঘিরেই প্রায় ৪০০ বছর আগে ব্যবসা-বাণিজ্যের শহর হিসেবে গড়ে ওঠে প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ। এখানে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের শিল্পকারখানা।
১০ থেকে ১৫ বছর আগেও নদীর পানি ছিল স্বচ্ছ ও জলজ প্রাণীর বাস উপযোগী। অনেকেই এ নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতেন। রান্না, গোসলসহ বিভিন্ন কাজে নদীর পানি ব্যবহার করা হতো। ভয়াবহ দূষণের কারণে নদীর পানি ব্যবহার তো দূরের বিষয়, নদী দিয়ে চলাচলই এখন দুরূহ হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিন প্রচুর মানুষকে কাজে যাওয়ার জন্য শীতলক্ষ্যা পার হতে হয়। নাকে রুমাল চেপেও তীব্র দুর্গন্ধ এড়ানো যায় না।
নদীপারের মোহাম্মদ জনি বলেন, ‘প্রতিদিন নদী পার হয়ে গার্মেন্টসে যেতে হয়। শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য পানিতে মিশে উৎকট গন্ধ ছড়ায়। নদীর কাছে দাঁড়িয়ে থাকাই যায় না। সেখানে এই পানির ওপর দিয়ে যাতায়াত করা খুব কষ্টের। আবার এভাবে যাতায়াত ছাড়া উপায়ও নেই।’
বন্দরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হারুন মিয়া বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে এই নদীতে গোসল করি। এখন তো নদীর পানি নষ্ট হয়ে গেছে। তাও ছোটবেলার স্বাদ মনে রাখার জন্য এখানে গোসল করি। পরে বাড়িতে গিয়ে আবার গায়ে পানি ঢালি।
‘একসময় নদীর পানি অনেক ভালো ছিল। নিচ পর্যন্ত দেখা যেত। এখন সেই নদী একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে।’
কলকারখানা অধিদপ্তর ও নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জে ৩ হাজার ৫৫০টি বিভিন্ন শ্রেণির কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে তরল বর্জ্য নির্গত হয় ৫০৪টি কারখানার। বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) আছে ৩১৭টি প্রতিষ্ঠানের। ইটিপি ও ছাড়পত্র নেই ১১৮টির।
প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার অপরিশোধিত শিল্প ও গৃহস্থালির তরল বর্জ্য পড়ছে শীতলক্ষ্যায়। নদীর পানিতে ময়লা ও বর্জ্যের পরিমাণ ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। শীতলক্ষ্যার প্রতি লিটার পানিতে ৪ থেকে ৬ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকার কথা থাকলেও আছে ১ থেকে ২ মিলিগ্রাম। এতে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর বসবাস অনুপযোগী হয়ে উঠেছে নদীটি।
নদী ঘুরে দেখা যায়, নিতাইগঞ্জ থেকে আড়াইহাজারের গোপালদী পর্যন্ত অন্তত অর্ধশতাধিক খাল-বিল, নালা ও ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি নদীতে গিয়ে বিভিন্ন বর্জ্য পড়ছে। এসব বর্জ্যের মধ্যে আছে বিভিন্ন এলাকার কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের রাসায়নিকমিশ্রিত পানি, রং, পলিথিন, গৃহস্থালি বর্জ্য, হাটবাজারের উচ্ছিষ্ট, হোটেল-রেস্তোরাঁর আবর্জনা।
দূষণের হাত থেকে শীতলক্ষ্যাকে বাঁচাতে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নারায়ণগঞ্জ শাখা।
সংগঠনটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কারখানাগুলো রাসায়নিক বর্জ্য ও পানি পরিশোধন ছাড়াই নদীতে ফেলে। ইটিপি থাকলেও তা ব্যবহার করে না। এই নদীকে বাঁচাতে হলে পরিবেশ দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের কঠোর হতে হবে। শুধু নামমাত্র জরিমানায় দায়িত্ব শেষ করা যাবে না।
‘বছরের পর বছর নোটিশ করার পরও যেসব প্রতিষ্ঠান এখনও বর্জ্য পরিশোধনে ইটিপি প্ল্যান্ট নির্মাণ করেনি তাদের কারখানা বন্ধ করা প্রয়োজন। যদি নদীনালা, খালবিল এগুলো বাঁচানো না যায় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিপদে পড়বে।’
নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘যারা আইন মানছে না তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিশেষ আদালতে মামলা করা হচ্ছে। যাদের কারখানায় ইটিপি থাকার পরও ব্যবহার করছে না তাদের কারখানার নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে।
‘যারা পরিবেশ দূষণ করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া চলমান। জরিমানাসহ কারখানা বন্ধ করে দেয়া এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নও করা হয়। ইটিপি না থাকায় গত দুই মাসে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ নিট ম্যানুফেকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লোকাল কারখানা ও ডাইংগুলোতে ইটিপি নেই কিন্তু রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোতে ইটিপি রয়েছে এবং সেগুলো ব্যবহার করা হয়। ছোট কারখানাগুলোর পুঁজি কম হওয়ায় তারা ইটিপি স্থাপন করতে পারে না। যদি নদী দূষণ বন্ধ করতে হয় তাহলে সেন্ট্রাল ইটিপি স্থাপন করতে হবে এবং সেখান দিয়ে পানি পরিশোধনের পর নদীতে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
‘এ জন্য সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে। যাদের ইটিপি নেই তারা বেশির ভাগই বিকেএমইএর সদস্য নয়। তাই তাদের সতর্ক করার জন্য নোটিশ দেয়া যায় না।’