বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সেতু আছে, নদীটাই হাওয়া

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ১৪ মার্চ, ২০২২ ১০:৫৪

ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ স্থানেই নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু আমভিটা এলাকায় থাকা নদীর অংশটুকুতে কিছুটা পানি রয়েছে। তবে তা কচুরিপানায় পরিপূর্ণ। সেখানে নদীর প্রস্থ এখন ১০ মিটারেরও কম।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বালিয়াখালী সেতুর পশ্চিম পাশের উঁচু সড়ক থেকে দক্ষিণে তাকালেই দেখা মেলে একটি সড়কের। সেই সড়কটি গিয়ে শেষ হয়েছে হামকুড়া নদীতে।

একসময় ফেরির মাধ্যমে নদীটি পার হতে ওই সড়ক দিয়েই ঘাটে যেতে হতো। বালিয়াখালী সেতু হওয়ার পর ওই সড়ক আর ব্যবহার হয় না। বর্তমানে ফেরি পারাপারের সেই সড়ক এমনকি সেতুটি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও নেই নদীর কোনো অস্তিত্ব।

সেতুটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে এর দুই পাশে যতদূর চোখ যায় নদীর বদলে দেখা যায় শুধু ধানক্ষেত। একসময় এখান দিয়ে যে একটি নদী বয়ে গিয়েছিল, সেতুটিই তার প্রমাণ। যে সে নদী নয়, হামকুড়া নদীকে একসময় প্রমত্তা হিসেবেই দেখেছে স্থানীয়রা।

ডুমুরিয়া উপজেলার বুক চিরে বয়ে চলা হামকুড়ার বুক এখন বিস্তীর্ণ এক জনপদ। মাত্র দুই যুগ আগেও যে নদী দিয়ে ছোট-বড় অসংখ্য নৌকা, ইঞ্জিনচালিত ট্রলার আর লঞ্চ চলেছে- সেই নদীর বুকে গড়ে উঠেছে এখন শত শত ঘর-বাড়ি। গড়ে উঠেছে ইটভাটা, স্কুলসহ নানা প্রতিষ্ঠানও।

যে যার মতো ভরাট হওয়া নদীর বুক দখল করে রেখেছেন। ভবিষ্যতে খনন করে নদীটিকে আবারও স্রোতস্বিনী করার জায়গাও এখন আর ফাঁকা নেই।

দুটি নদীর সংযোগ ছিল হামকুড়া। এর উত্তরে শ্রীনদী, দক্ষিণে ভদ্রা। শ্রীনদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বিস্তীর্ণ বিল ডাকাতিয়ার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে দক্ষিণ ভদ্রায় গিয়ে মিশেছে হামকুড়া।

গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুতে বিলডাকাতিয়া অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে ওই অঞ্চলের মানুষ বিলডাকাতিয়ার আমভিটাসহ চারটি স্থানের বাঁধ কেটে দেয়। এতে বিলের সঙ্গে নদীটির সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়। ভদ্রার জোয়ারের পানি হামকুড়া হয়ে বিল ডাকাতিয়ায় উপচে পড়ে।

বছর দুয়েক পর কে-জেডিআরপি (খুলনা-যশোর ড্রেনেজ রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট) প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাঁধের কাটা অংশ আটকে দিলে মাস তিনেকের মধ্যেই শুকিয়ে যায় হামকুড়া। সেই থেকে নদীটির ওপর ছোট-বড় নানা স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে স্থানীয় লোকজন।

ডুমুরিয়া এলাকাটি খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১-এর (পাউবো) আওতায়। ওই কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, হামকুড়া নদীটির দৈঘ্য প্রায় ১৪ কিলোমিটার। উপজেলার থুকড়া, রূপরামপুর, গজেন্দ্রপুর, শাহপুর, মধুগ্রাম, হাসানপুর, মিকশিমিল, বালিয়াখালীসহ কয়েকটি গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এই নদী।

কিছুদিন আগে হওয়া বৃষ্টির পানি জমিতে আটকে গেছে। এতে ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ স্থানেই নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু আমভিটা এলাকায় থাকা নদীর অংশটুকুতে কিছুটা পানি রয়েছে। তবে তা কচুরিপানায় পরিপূর্ণ। সেখানে নদীর প্রস্থ এখন ১০ মিটারেরও কম।

এ ছাড়া অন্যান্য এলাকায় নদীর বুকজুড়ে চলছে চাষাবাদ। কিছু কিছু জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ছোট বড় স্থাপনা, রয়েছে ইটভাটাও। এমনকি বালিয়াখালী সেতুর পশ্চিম পাশের ঠিক নিচেও গড়ে তোলা হয়েছে কয়েকটি মাটির ঘর।

বালিয়াখালী সেতুর নিচে মাটির ঘর। ছবি: নিউজবাংলা

সেতুসংলগ্ন এলাকার কয়েকটি দোকানের একটির মালিক সমীর কুমার মণ্ডল। বয়স ৪০ ছুঁইছুঁই। তিনি বলেন, ‘ছোট থাকতে দেখেছি হামকুড়া নদী দিয়ে নৌকা ও বড় বড় লঞ্চ চলত। ফেরি পারাপারের মাধ্যমে সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা হতো। কিন্তু দেখতে দেখতে নদীটি শুকিয়ে গেল। আর শুকানোর সঙ্গে সঙ্গে এক শ্রেণির মানুষ দখল করে নিল নদীর বুক। এখন আর নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। বর্ষা মৌসুমে তাই পানি আটকে এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।’

নদীর তীর ধরে উত্তর দিকে কিছুটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে ধানের জমি থেকে সেচযন্ত্রের সাহায্যে পানি সরিয়ে ফেলছেন টিপনা গ্রামের মেহেদী হাসান। জমি থেকে পানি সরানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে হওয়া বৃষ্টির পানি জমিতে আটকে গেছে। এতে ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’

বর্ষা মৌসুমে এমন জলাবদ্ধতা আরও ভয়াবহ হয় বলে জানান তিনি। তখন ফসল আর পুকুরের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। নদী না থাকায় প্রতি বছরই এমন সমস্যায় পড়তে হয়।

ডুমুরিয়ায় বড় নদীর মধ্যে হামকুড়া একটি। নদীটি গিয়ে পড়েছে ভদ্রা নদীতে। নদীটি খননের বিষয়ে একটি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনটি যাচাই করতে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

সেতুর নিচে যারা ঘর করে আছেন তাদের একজন সালাম বিশ্বাস। তার স্ত্রী মমতাজ বেগম জানান, প্রায় ২০ বছর ধরে সেতুর নিচে তারা পরিবার নিয়ে বাস করছেন। ঘর-বাড়ি ও জমি না থাকায় তারা সেতুর নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। যদি কখনও নদী খনন হয় তাহলে তারা অন্যত্র চলে যাবেন।

নদীসংলগ্ন এলাকাগুলোর অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। এর মধ্যে নদীসংলগ্ন বিলে জমি আছে এমন ৫ জনকে পাওয়া যায়। তাদের সবাই এখন চান- নদীটি খনন করা হোক। তাদের দাবি, যারা নদীর অবৈধ জমি দখল করে আছেন, নদী খনন হলে তারা ছাড়া সবাই খুশি হবেন। এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কমবে। উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমির জলাবদ্ধতা দূর হবে। বাড়বে ফসলের উৎপাদনও। এলাকার মানুষের মাছের চাহিদাও পূরণ হবে এই নদী থেকে।

খুলনা পাউবো-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডুমুরিয়ায় বড় নদীর মধ্যে হামকুড়া একটি। নদীটি গিয়ে পড়েছে ভদ্রা নদীতে। নদীটি খননের বিষয়ে একটি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনটি যাচাই করতে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’

খুলনা অঞ্চলের নদ-নদী নিয়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে গবেষণা করছেন গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকার নদী জীবিত রাখার শর্ত হচ্ছে, উজান-ভাটা উভয় দিকে প্রবাহ বজায় রাখা। এই অঞ্চলের নদীগুলোর বেশির ভাগই উজান থেকে বিচ্ছিন্ন। এ জন্য জোয়ারের চাপ বেশি ও জোয়ারে আসা পলিমাটি বেশি পরিমাণে নদীগর্ভে জমা হয়। হামকুড়া নদীর উজানের অংশও বন্ধ রয়েছে। ফলে জোয়ারে আসা পলিমাটি জমা হয়ে নদীটি মারা গেছে।’

তিনি মনে করেন, নদীটি খনন করে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) করলে আবার খরস্রোত ফিরে পাবে। একই সঙ্গে নদীতীরবর্তী মানুষ উপকৃত হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর