দেশে ই-কমার্স খাতে পণ্য কেনাবেচা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎসহ নানা প্রতারণা।
ভোক্তা বা গ্রাহকের সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতারণা রোধে পুরো ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ন্যায্যতা আনতে চায় সরকার। সে জন্য চলতি বছরকে ই-কমার্স খাত সংশোধন ও পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য ধরে পরিকল্পনা সাজানোর কথা জানানো হয়েছে।
এ লক্ষ্যে সংশোধন পর্যায়ে থাকা ভোক্তা আইনে অনলাইনে লেনদেনের বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হবে। এ ছাড়া ই-কমার্স খাতের সুষ্ঠু পরিচালনায় হালনাগাদ একটি পরিপূর্ণ নীতিমালা শিগগির প্রকাশ করা হবে। জারি করা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরসও (এসওপি) করা হবে হালনাগাদ।
ইতোমধ্যে ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ডিবিআইডি) কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে সারা দেশে সব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং এফ-কমার্স সাইটগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে।
এ খাতের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আওতায় চালু করা হবে সেন্ট্রাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সার্ভার।
ই-কমার্স খাতে কী পরিমাণ ট্রানজেকশন হয়, কারা কোথায় কী পরিমাণ পণ্য কেনাবেচা করে, তা পর্যবেক্ষণের জন্য সেন্ট্রাল লিকুইডিটি ট্র্যাকিং প্রোগ্রামও (সিএলটিপি) চালু করা হবে।
যেগুলো ট্র্যাকিং করা সম্ভব নয়, তাদের বিষয়ে দেখভালের জন্য আরও একটি ইন্টার অপারেটর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হবে। এসব লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসূচির কার্যকর পদক্ষেপে সরকার এ বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র আইন ও কর্তৃপক্ষ গঠনেও জোরালোভাবে কাজ করছে। এসব পদক্ষেপ ই-কমার্স খাতকে বিতর্কমুক্তভাবে এগিয়ে নেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে চলতি বছর বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালনে সরকার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থায় ন্যায্যতা’। নানা কর্মসূচিতে আগামীকাল পালন হতে যাচ্ছে এই দিবস।
বিদ্যমান ই-কমার্স বা অনলাইন মাধ্যমে কেনাকাটাতে পণ্য যাচাইয়ের সুযোগ কম। ফলে এখানে নিম্নমান, অন্য পণ্য গছিয়ে দেয়া, বাড়তি দাম রাখা, অন্যায্য ভ্যাট আদায়, ওজনে কম- এমন নানামুখী প্রতারণার শিকার হচ্ছে ক্রেতারা। আবার অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করেও মাসের পর মাস পণ্য বা টাকা কোনোটাই ফেরত না পাওয়ার অভিযোগও এখন সর্বোচ্চ।
এদিকে শুধু অনলাইন কেনাকাটাতেই নয়, সশরীরে কেনাকাটাতেও বিভ্রান্ত হচ্ছে ভোক্তা। যেখানে আসল-নকল কিংবা দামের মারপ্যাঁচে প্রতিনিয়ত ক্রেতাকে ঠকানো হচ্ছে। অর্থাৎ সবখানেই ভোক্তা বঞ্চনার হার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধে দেশে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন করা হয়। এ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ভোক্তা স্বার্থ তদারকিতে একই বছর গঠন করা হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। একই সঙ্গে আইনটি বাস্তবায়নের জন্য এ পর্যন্ত ৫টি বিধিমালা ও প্রবিধান তৈরি হয়েছে।
দেশব্যাপী ভোক্তা অধিকার আইন বাস্তবায়নের জন্য বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২৯ সদস্যবিশিষ্ট সর্বোচ্চ ফোরাম হিসেবে কাজ করছে ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।’
এ ছাড়া সব জেলায় জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে রয়েছে ১১ সদস্যের জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটি। উপজেলা চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে আছে ১৮ সদস্যের উপজেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটি। সব ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে ২০ সদস্যের ইউনিয়ন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটিও কাজ করছে। এর বাইরে বেসরকারি উদ্যোগে আগে থেকেই কাজ করে আসছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব)।
এত সব উদ্যোগও দেশে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা ও ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা দমাতে পারেনি। অনলাইন কিংবা সশরীরে- কোনো মাধ্যমেই পণ্য বিক্রিতে মানা হয় না নির্ধারিত দাম। দেখানো হয় না মূল্য তালিকা। উল্টো প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রকাশ্যে খাদ্যপণ্য, ব্যবহৃত পণ্য ও ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ধার্য মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে।
থেমে নেই ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রিও। নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ দেয়া হচ্ছে মানব খাদ্যে। অবৈধ প্রক্রিয়ায় মানহীন পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ চলছে সমানতালে। ক্রেতা-ভোক্তাকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে মিথ্যা প্রলোভনের বিজ্ঞাপনে। ওজনে কারচুপি হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য।
কেন এই প্রতিপাদ্য
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২১ সালটি ছিল ই-কমার্স খাতে নানামুখী প্রতারণার ঘটনাবহুল বছর। গত বছরের জুন মাসে গ্রাহকরা ১৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সেপ্টেম্বরে এসে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১টি।
লাফিয়ে বেড়েছে অভিযোগের সংখ্যাও। সেপ্টেম্বর শেষে এ অভিযোগের সংখ্যা ২২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। অথচ তিন মাস আগে জুন মাসে এ সংখ্যা ছিল ১৩ হাজারের মতো।
শুধু ই-কমার্স ওয়েবসাইট নয়, ফেসবুকভিত্তিক কমার্স সাইটগুলোর বিরুদ্ধেও উঠেছে অসংখ্য অভিযোগ। এসব অভিযোগের ৯০ শতাংশই আবার ঢাকাকেন্দ্রিক।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ডিজিটাল কমার্স সেল প্রধান এ এইচ এম সফিকুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্রেতা-ভোক্তার সঙ্গে অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণার অভিযোগ পাওয়ার পর তা ঠেকাতে সরকার বসে নেই।
অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে একের পর এক অভিযান চালানো হয়েছে। অনেককে আটক করে জেলে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ পালিয়ে গেছে। তবে তাদের প্রতিষ্ঠান, সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব জব্ধ করা হয়েছে। যাদের টাকা বিভিন্ন গেটওয়েতে আটকা ছিল তা যাচাই-বাছাই করে ফেরত দেয়া হয়েছে।
অনলাইন গ্রাহকের সুরক্ষা ঝুঁকি
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ পুরোপুরি ভোক্তাবান্ধব নয়। আবার এ আইনে অনলাইন গ্রাহকের সুরক্ষার বিষয়টিও অস্পষ্ট। যে কারণে ডিজিটাল মাধ্যমের ক্রেতা-ভোক্তা কিংবা গ্রাহকের একটা সুরক্ষা ঝুঁকি ছিল।
টেলি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (টিক্যাব) আহ্বায়ক মো. মুর্শিদুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এ দেশের প্রচলিত পণ্যের গ্রাহকদের কথা উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু এ আইনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের গ্রাহকদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই।
‘দেশে ই-কমার্স জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাড়ছে ই-কমার্স সেবা ও অনলাইনকেন্দ্রিক লেনদেনের প্রবণতা। এটা ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু এই ই-কমার্স, অনলাইন রাইড শেয়ারিং, অনলাইন ফুড ডেলিভারি সিস্টেম, ই-টিকেটিং, বিভিন্ন সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট ও অ্যাপের ক্রেতা, অনলাইনে বিভিন্ন সেবার গ্রাহক, মোবাইল ব্যাংকিং খাতের গ্রাহক এবং টেলিকম সেক্টরের ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় ভোক্তা আইনে স্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় ভোক্তা অধিকার রক্ষার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।’
ভোক্তা অধিকারে আরও যত বাধা
ভোক্তা অধিকার রক্ষায় রয়েছে পদে পদে বাধা। এর জন্য কেবল ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতাই দায়ী নয়। সরকারের ভুলনীতি, নজরদারির অভাব, ভোক্তাবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা, রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগের এ বিষয়ে আন্তরিকতার অভাব এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির দৌরাত্ম্যও দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘যেকোনো সেবার উৎপাদন ভোক্তার কাছে যাচ্ছে চার গুণ দামে। অকারণে নানাভাবে এসবের মূল্য বাড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে সরকার যে বরাদ্দ দিচ্ছে তা ভোক্তাদের জন্য খরচ হচ্ছে কি না, সেটা ভোক্তাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।’
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় সরকার আইনের মধ্যে থেকেই বেশকিছু রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান গঠন করে দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করছে না, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) তার একটি।
অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার রক্ষায় দরকার ভোক্তাবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠা। একই সঙ্গে দরকার অর্থনীতি ও রাজনীতির সংযোগ। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ ও আইন বিভাগ অধিকতর আন্তরিক হওয়ার বিকল্প নেই। তা না হলে ভোক্তাদের বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হতে হবে।’
সর্বাধিক গুরুত্ব সরকারের
ভোক্তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
নিউজবাংলাকে মন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ভোক্তা সুরক্ষার বিষয়ে আন্তরিক বলেই দেশে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে বাজার অভিযান জোরদার করেছে। একচেটিয়া বাণিজ্য বন্ধ এবং ব্যবসায় প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে গঠন করা হয়েছে প্রতিযোগিতা কমিশন। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতেও তৎপর সরকার। এ লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণয়ন এবং কর্তৃপক্ষ গঠনের মাধ্যমেও এ বিষয়ক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
‘এটা ঠিক এখনও ভোক্তারা পুরোপুরি সচেতন হয়নি। আমি মনে করি সর্বত্র ভোক্তারা সচেতন হলেই দেশে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত হবে।’
সরকার ভোক্তাদের সচেতন করতেও কাজ করছে বলে দাবি করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভোক্তা-স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অনেক ভোক্তাই তার অধিকার সম্পর্কে এখন সচেতন। তারা প্রতিবাদ করছেন, অভিযোগও দিচ্ছেন। বাজার ব্যবস্থায় বহুমুখিতার কারণে প্রতারণার ধরন বদলে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এখন যুগোপযোগী করতে সংশোধনের অপেক্ষায় রয়েছে।
‘ই-কমার্স খাতের সুষ্ঠু পরিচালনায় একটি পরিপূর্ণ হালনাগাদ নীতিমালা চূড়ান্তকরণের অপেক্ষায় রয়েছে। একটি এসওপি জারি হয়েছে। এর পাশাপাশি সরকার এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র আইন ও কর্তৃপক্ষ গঠনে কাজ করছে।’