করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে করোনা ও এর প্রভাবে তৈরি বিভিন্ন কারণে বিশ্বে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবের তিনগুণ বলে দাবি করা হয়েছে চিকিৎসাবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে।
এতে বলা হয়েছে, গত দুই বছরে করোনা মহামারির অভিঘাতে বিশ্বে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তবে বিভিন্ন দেশের সরকারি হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ।
১০ মার্চ প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে।
এতে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত করোনা মহামারির অভিঘাতে প্রায় চার লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে এই দাবিকে ‘বিভ্রান্তিকর ও অদ্ভুত’ বলে দাবি করছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা।
ল্যানসেটের গবেষণাপত্রে বলা হয়, ‘করোনাভাইরাস পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, মৃত্যুর কারণের তথ্য ঠিকমতো রেকর্ড না করা ও কিছু দেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় করোনার মৃত্যু কম করে দেখানোয় এতদিন করোনার কারণে মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি।’
গবেষণায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সরাসরি মৃত্যুর পাশাপাশি করোনার কারণে সৃষ্ট শারীরিক জটিলতায় মৃত্যুকেও বিবেচনায় আনা হয়েছে। একই সঙ্গে করোনা সংক্রমণের কারণে ফুসফুস বা হৃদপিণ্ড অকেজো হয়ে মৃত্যু ও করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনাকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই আইটেমের গবেষণা আগেও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। করোনায় বাংলাদেশে ২৯ হাজারের একটু বেশি মানুষ মারা গেছেন। এর বেশি মৃত্যু হলেও সেটি পাঁচ থেকে ১০ শতাংশের বেশি হবে না।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এসএম আলমগীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনটি আমি দেখেছি। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করলে গবেষণাটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অপ্রত্যাশিত। দেশে এমনিতেই প্রতিবছর ৮ লাখ ৮৮ হাজারের মতো মানুষ মারা যান। দেশে করোনায় যারা মারা গেছে তার ৫০ শতাংশ বেশি রোগী যদি মারা যেত তাহলে রাস্তাঘাটে মানুষ মরে পড়ে থাকত।’
তিনি বলেন, ‘এমন আইটেমের অনেক গবেষণা এর আগে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক দেশ এই গবেষণার ফলাফলকে অদ্ভুত বলে আখ্যা দিয়েছে। জাপানে মৃত্যু দেখিয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার। জাপানে কিন্তু জন্ম-মৃত্যু শতভাগ নিবন্ধন করে। জাপানে এমন ঘটনা ঘটেনি।’
এসএম আলমগীর বলেন, ‘গবেষণা করতে গিয়ে তারা যে ১০ থেকে ১২ ধরনের তথ্য ব্যবহার করেছে সেটি এই গবেষণার জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি মৃত্যু এখন রেকর্ড হয়।’
তিনি বলেন, ‘এই গবেষণা নিয়ে আরও বেশি পড়াশোনা করতে হবে। যারা গবেষণাটি করেছের সেটি বাংলাদেশের জন্য আসলে প্রযোজ্য কি না সেটাও দেখার বিষয়। তারা তাদের গবেষণাপত্রেই উল্লেখ করেছেন, এই গবেষণা ফলাফলের তথ্য সঠিক হতেও পারে বা নাও হতে পারে।’
এসএম আলমগীর বলেন, ‘গবেষণার শিরোনামে উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে। এটা বিভ্রান্তিকর। ইতোমধ্যে জাপান থেকে থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ভারতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই গবেষণাকে অদ্ভুত বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘এমন একটি গবেষণা দেশে করোনা প্রবেশের পরপরই প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে করোনায় এতো মানুষ আক্রান্ত হলে তো হাসপাতালে জায়গা হবে না। সেটা তো আসলেই সঠিক হয়নি। এই গবেষণাটি বার্ষিকী করা হয়েছে। বিজ্ঞানে আসলে বার্ষিকী কোনো জিনিস নেই। সব কিছু মিলেই আমার মনে হয় বৈজ্ঞানিকভাবে এটা সঠিক নয়।’
এসএম আলমগীর বলেন, ‘আমরা আশা করছি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশ্বের সব দেশের করোনা মৃত্যুর পরিসংখ্যান প্রকাশ করবে। এই গবেষণাটি প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির কোভিড-১৯ একসেস মরটালিটি টিম। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য টিম এই গবেষণার ফলাফল অদ্ভুত বলেছে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও করোনা নিয়ন্ত্রণে পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হঠাৎ করেই কোনো দেশ এমন তথ্য দিতে পারে না। কারণ সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে। এছাড়া সরকার থেকে প্রতিদিন করোনা আপডেট প্রকাশ করা হচ্ছে। তাদের গবেষণায় পদ্ধতিগত ক্রটি রয়েছে। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানানোর প্রয়োজন ছিল।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। যে কারণ তারা চায় আমাদের দেশে বেশি মৃত্যু হোক বা হয়েছে এটা প্রমাণ করতে। যদি এত সংখ্যাক মানুষ মারা যেতে তাহলে গণমাধ্যমকর্মীরা এই সংবাদ আগে জানার কথা। আসলে বাংলাদেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। করোনায় দেশে ২৯ হাজার মানুষ মারা গেছেন এটা সবাই জানে।’
চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়ার পর ২০২০ সালের ১১ মার্চ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। এর দুই বছর পরেই চিকিৎসাবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে মৃত্যুর নতুন পরিসংখ্যান হাজির করা হলো।
গবেষক দলের প্রধান ও ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড এভালুইয়েশনের পরিচালক ক্রিস মুরে বলেন, ‘এই মহামারি কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ ছিল। করোনার কারণে বৈশ্বিক মৃত্যু প্রায় ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।’
গবেষক দলের মতে, মৃত্যুর সঠিক হিসাব ছাড়া করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব ঠিকমতো বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রগুলোর উচিত করোনায় মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান রাখা। গবেষণার জন্য মোট ৭৪টি দেশের ডেটা ব্যবহার করা হয়েছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনাভাইরাসে সরকারি হিসাবের বাইরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ভারতে। দেশটিতে করোনায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এরপরেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। এই দেশ দুটিতে করোনায় প্রায় ১০ লাখ করে মানুষের মৃত্যু হয়েছে।