গাজীপুরের টঙ্গীর একটি বাড়িতে মাদক উদ্ধারের অভিযানে যান টঙ্গী পূর্ব থানার ৩ এসআই। আতাউর রহমান মৃধা নামের এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে তারা কয়েক বোতল ফেনসিডিল জব্দ করেন। তবে আটক করা যায়নি কাউকে।
এ ঘটনা গত ২৭ ফেব্রুয়ারির। অথচ গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত থানায় ওই অভিযানের তথ্য রেকর্ড করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের অভিযানে আসামি গ্রেপ্তার না হলেও থানায় সাধারণ ডায়েরি করে জব্দ করা মালামালের তালিকাসহ তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে পাঠাতে হয়। এ অভিযানের ক্ষেত্রে সেটাও করা হয়নি। অবশ্য একে স্রেফ ‘ছোট ঘটনা’ হিসেবে দাবি করছেন থানার ওসি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, আতাউরের সঙ্গে ঘটনাস্থলেই আর্থিক লেনদেন হয় ওই ৩ এসআইয়ের। এ কারণে থানায় রেকর্ডভুক্ত করা হয়নি অভিযানের তথ্য।
অভিযানে যাওয়ার ও ফেনসিডিল জব্দের বিষয়টি স্বীকার করেছেন থানার এসআই আশিকুল হক রোনাল্ড, এসআই লিটন শরিফ ও এসআই মো. রাজিব। তবে থানায় সেটি রেকর্ড না করার কারণ জানতে চাইলে তারা সুস্পষ্ট কোনো জবাব দেননি।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (টঙ্গী জোন) পিযুষ কুমার দে জানান, এ ধরনের কোনো অভিযান হয়েছে বলে কোনো তথ্য তার কাছেও নেই।
সেদিনের অভিযানের একটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ নিউজবাংলার হাতে এসেছে। ক্যামেরাটি লাগানো আতাউরের পাশের বাড়ির বাইরে। সেই ফুটেজের সূত্র ধরেই অভিযান ও জব্দ করা ফেনসিডিল গায়েব হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক।
ওই ফুটেজে দেখা যায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১১টার দিকে টঙ্গীর বনমালা সড়কের টিভিএস গোডাউনের পাশে আতাউরের বাড়িতে প্রবেশ করেন এসআই আশিকুল ও লিটন।
মাদক উদ্ধারে অভিযান চালানো টঙ্গী পূর্ব থানার ৩ এসআইএর কিছুক্ষণ পরই ভেতর থেকে এক যুবককে দৌড়ে পালাতে দেখা যায়। তাকে ধাওয়া করতে দেখা যায় এসআই আশিকুল ও লিটনকে। কিছু সময় পর তারা ওই যুবককে ছাড়াই ফিরে আসেন, ওই বাড়িতে ঢোকেন। মোটরসাইকেলে করে সেখানে পৌঁছান আরেক ব্যক্তি। তিনিও ওই বাড়িতে প্রবেশ করেন।
এরপর ভেতর থেকে একটি বড় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হন সেই ব্যক্তি। তখন ৩-৪ জন কনস্টেবল নিয়ে সেখানে হাজির হন থানার আরেক এসআই রাজিব। ওই ব্যক্তিসহ পুলিশ সদস্যরা এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর বড় ব্যাগটি কাঁধে নিয়েই মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে দেখা যায় সেই ব্যক্তিকে।
ওই বাড়ির আশপাশের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেই ব্যক্তির নাম আল-আমিন। তিনি এসআই আশিকের ব্যক্তিগত সোর্স ও ড্রাইভার।
আতাউরের প্রতিবেশীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওই রাতে পুলিশের লোকজন আতাউরের বাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের জানান, ওই বাড়ি থেকে ব্যাগভর্তি ফেনসিডিল পাওয়া গেছে।
আতাউরের বাড়ির সামনেই মুদির দোকান মো. বাবুলের।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই রাতে একদল পুলিশকে দৌড়াতে দেখেছি। তখন আশপাশের অনেক লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন আমার দোকানেই বসা ছিলাম।
‘পরে পুলিশ বাড়ি থেকে বের হয়ে ফেনসিডিল উদ্ধারের বিষয়টি উপস্থিত সবাইকে জানায়। একটা সাদা কাগজে কয়েকজনের নাম-ঠিকানাও লিখে নেয় পুলিশ।’
আতাউরের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিবেশীরা জানান, এলাকায় তিনি ফেনসিডিল কারবারি হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে বছর দুয়েক আগে পুলিশ সদস্যদের মারধরসহ একাধিক মামলা আছে বলেও দাবি তাদের।
প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আতাউরের মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে কল দেয় নিউজবাংলার প্রতিবেদক। তবে তিনি অভিযানের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, ‘কই আমি তো এমন কিছু শুনি নাই... রাতে আমি বাসায় ছিলাম না... কোনো ফেনসিডিল উদ্ধারের কথা তো আমাদের কেউ বলে নাই।
‘ওই এলাকায় তো সব সময়ই পুলিশ আসে... পুলিশকে তো জেরা করা যায় না কেন গেছে।’ সে বাড়ির অন্য বাসিন্দারাও ওই রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে মুখ খুলতে রাজি হননি।
তাদের (ওই ৩ এসআইয়ের) পদ্ধতিগত ভুল হয়েছে, তবে অনৈতিক কোনো কিছুর প্রমাণ আমি কিন্তু পাইনি... খবর আসছে একটা চালান আসছে, বাট কিছু ডিস্ট্রিবিউট হয়ে গেছে আগেই, এ জন্য কিছু ইনফরমেশন গ্যাপ হয়ে গেছে... এরা বিষয়টি হালকাভাবে নিছে, ইমম্যাচিউরডলি নিয়েছে... এ বিষয়টা এলে কখনও ছোট ঘটনা বড় হয়ে যায়...।
পুলিশের সোর্স আল-আমিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক। প্রথমে তিনি অভিযানে অংশ নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেন।
তবে একপর্যায়ে স্বীকার করে বলেন, ‘ওই রাতে আশিক স্যার ফোন করে আমাকে ঘটনাস্থলে ডেকে নেন। পরে এসআই লিটন শরিফ স্যার একটি ব্যাগ আমার হাতে তুলে দেন।’
ব্যাগে কী ছিল? আল-আমিন বলেন, ‘বই-খাতা ছিল ব্যাগে। ওই রাতেই থানায় এনে লিটন স্যারের কাছে দিয়েছি। এখন সেটা কোথায় আছে জানি না।’
মাদক উদ্ধারের বিষয়টি জানা নেই বলে দাবি করেন তিনি।
আল-আমিন নিজেকে এসআই আশিকের গাড়িচালক বলেই পরিচয় দেন।
টঙ্গী পূর্ব থানায় বৃহস্পতিবার এই অভিযানের বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায়, অভিযুক্ত মাদক কারবারি আতাউরের নামে ২০১৯ সালে একটি মামলা করেছিলেন তৎকালীন এসআই মো. জহুরুল। মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে এ বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, পুলিশের ওপর হামলার মামলা ছিল সেটি। তবে বিস্তারিত তথ্য তিনি মনে করতে পারছেন না।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি বা জিডি না করে থানার ডিউটি অফিসার অভিযান করতে পারেন না। অভিযানে যাওয়া এবং ফিরে আসার বিষয়েও একই নিয়ম।
থানায় গিয়ে আরও জানা যায়, অভিযানের সেই রাতে থানার ডিউটি অফিসার ছিলেন এসআই লিটন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী ডিউটি অফিসারকে অভিযানে যেতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আগে থেকে জানাতে হয়।
অভিযান প্রসঙ্গে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে এসআই আশিকুল বলেন, ‘ওই রাতে আতাউরের বাড়ি থেকে নয়, তার একটি অফিসে পরিত্যক্ত ঘরে ১১ বোতল ফেনসিডিল পাওয়া গেছে। সেগুলো জব্দ তালিকা করা হয়েছে। আসামি না পাওয়ায় মামলা করা যায় নাই।’
এসআই লিটন দাবি করেন, তিনি ওসিকে জানিয়েই অভিযানে গিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ‘ফেরার পর জিডি করি নাই, এটা আমার ভুল হয়েছে।’
ফেনসিডিলের বোতলগুলো থানাতেই আছে দাবি করে এসআই লিটন বলেন, ‘ভুলে সেগুলো রেকর্ডভুক্ত করিনি।’
অন্যদিকে এসআই রাজিব বলেন, ‘আমি অন্য জায়গায় ছিলাম। এসআই আশিকুল ও লিটনের ফোন পেয়ে ওই রাতে ঘটনাস্থলে গেছিলাম। ততক্ষণে তারা বের হয়ে গেছিল।
‘মামলা, জিডি বা জব্দের বিষয়ে তারাই (আশিকুল ও লিটন) ভালো বলতে পারবেন।’
অভিযানের পর ওই ৩ এসআইয়ের জিডি না করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ওসি জাবেদ মাসুদ। তিনি বলেন, ‘তাদের (ওই ৩ এসআইয়ের) পদ্ধতিগত ভুল হয়েছে, তবে অনৈতিক কোনো কিছুর প্রমাণ আমি কিন্তু পাইনি... খবর আসছে একটা চালান আসছে, বাট কিছু ডিস্ট্রিবিউট হয়ে গেছে আগেই, এ জন্য কিছু ইনফরমেশন গ্যাপ হয়ে গেছে... এরা বিষয়টা হালকাভাবে নিছে, ইমম্যাচিউরডলি নিয়েছে... এ বিষয়টা এলে কখনও ছোট ঘটনা বড় হয়ে যায়...।’
তিনি আরও বলেন, ‘আসামিকে ধরতে অভিযান চলছে, অনৈতিক কিছু হয়ে থাকলে আমি ব্যবস্থা নেব, তবে এমন কিছু হয় নাই।’
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (টঙ্গী জোন) পিযুষ কুমার দে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি বা জিডি না করে থানার ডিউটি অফিসার অভিযান করতে পারেন না। অভিযানে যাওয়া এবং ফিরে আসার বিষয়েও একই নিয়ম। তবে গত ২৭ ফেব্রুয়ারির ওই অভিযান সম্পর্কে আমি অবগত নই।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারও বাসায় মাদক পাওয়া গেলে কাউকে আটক করা না গেলেও বাড়ির লোকের নামে মামলা হবে। কোনো কিছু জব্দ হলে থানায় জিডিও হবে। এটাই নিয়ম।'