বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ছড়িয়ে পড়ছে নিষিদ্ধ মাদক ট্যাপেন্টাডল

  •    
  • ১২ মার্চ, ২০২২ ০৮:৩৭

মাদকাসক্তরা ইয়াবার বিকল্প হিসেবে ট্যাপেন্টাডল ওষুধ সেবন করছে। ইয়াবা না পাওয়া গেলেই তারা এটি হাতে তুলে নিচ্ছে। বাংলাদেশে এটির উৎপাদন নিষিদ্ধ হলেও প্রতিবেশী ভারতে এখনও এটি বৈধ হওয়ায় এটি পাচার হয়ে আসছে।

ইয়াবা ও পরবর্তীতে হেরোইনে আসক্ত ছিলেন বগুড়া শহরের এক যুবক। বছর তিনেক আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাদক ব্যবসা ঝিমিয়ে পড়েছিল। ওই সময় ইয়াবা হাতের কাছে না পাওয়ায় ট্যাপেন্টাডল নামের একটি ওষুধের দিকে ঝুঁকেছিলেন তিনি।

এখন নেশার জীবন থেকে ফিরে এসে তিনি অন্য মাদকাসক্তদের সুস্থ করে তুলতে কাজ করছেন।

৩৯ বছরের এ যুবক নিউজবাংলাকে বলেন, ট্যাপেন্টাডল বর্গের ওষুধটির কোনো স্বাদ নেই। কিন্তু ইয়াবা, হেরোইন যখন হাতের কাছে পাওয়া যেত না, তখন এটিই হয়ে ওঠে অনেকের নেশা করার ভরসা।

নেশার জগত থেকে ফিরে আসা ওই যুবক জানান, ধনী-গরিব সব শ্রেণির লোকজন এটা সেবন করে। তবে নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা বেশি খায়। তাদের কাছে এটা ইয়াবার বিকল্প।

ব্যথা নিরাময়ের জেনেরিক ওষুধ ট্যাপেন্টাডলের চাহিদা বেশি দিন আগের নয়। দু বছর আগে এটি বৈধ ওষুধ ছিল। দেশের আটটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এটি বাজারজাত করত। নেশা হিসেবে ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালে ট্যাপেন্টাডল নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর থেকে দেশীয়ভাবে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

নিষিদ্ধ হলেও ওষুধটির ব্যবসা বন্ধ হয়নি। জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন ফার্মাসিতে এখনও এটি বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া গোপনে হাতে হাতে এর বিক্রি তো রয়েছেই।

স্বল্প দামের ওষুধ হওয়ায় শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জে সবার অগোচরে এটি ছড়িয়ে পড়েছে।

পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যতটুকু জব্দ হয়েছে, তার কয়েকগুণ বেশি ট্যাপেন্টাডল বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে।

বগুড়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জেলায় গত তিন মাসে প্রায় ২২ হাজার নিষিদ্ধ ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট জব্দ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

প্রশ্ন উঠেছে, দেশে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও বাজারে এটি আসে কীভাবে? এ ছাড়া মানুষের মাঝে এই ওষুধের চাহিদা কেন হলো?

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, মাদকাসক্তরা নেশাদ্রব্য ইয়াবার বিকল্প হিসেবে ট্যাপেন্টাডল ওষুধ সেবন করছে। ইয়াবা না পাওয়া গেলেই তারা এটি হাতে তুলে নিচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বলছে, বাংলাদেশে এটির উৎপাদন নিষিদ্ধ হলেও প্রতিবেশী ভারতে এখনও এটি বৈধ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কালোবাজারে অতিরিক্ত মূল্য হওয়ায় ভারত থেকে এসব সরবরাহ করছে মাদক ব্যবসায়ীরা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানায়, ট্যাপেন্টাডল মূলত ব্যথানাশক ওষুধ। এই ওষুধে অ্যামফেটামিন রয়েছে, যার কারণে এটিকে নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে অনেকে। অনেক মাদকসেবী ট্যাপেন্টাডলকে ইয়াবার মতো আগুনে পুড়িয়ে সেবন করে থাকে।

পরবর্তীতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রস্তাব মতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ ট্যাপেন্টাডল বাতিলের সুপারিশ করে। ফলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৬৫ ধারা অনুযায়ী ওই আইনে ‘খ’ শ্রেণির মাদকদ্রব্য হিসেবে টাপেন্টাডলকে তফসিলভুক্ত করা হয়।

জেলায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার অনুমোদিত ওষুধের দোকান আছে। এর মধ্যে শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় অর্ধশতাধিক দোকানে কোনো ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ‘নেশাজাতীয়’ এমন ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। শহরের খান মার্কেট, তিনমাথা এলাকায় হাত বাড়ালেই এ ওষুধ পাওয়া যায়।

এ ছাড়া বখশিবাজার, বউবাজার ও কলোনিতে কিছু নির্দিষ্টি দোকানে এসব ওষুধ কেনেন দরজিসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমিক। শহরের একটু দূরে ফুলবাড়ি ও মাটিডালি, চেলোপাড়া, তিনমাথা, চারমাথা, সাবগ্রাম এলাকার বিভিন্ন দোকানে এসব ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে।

এসব দোকান থেকে কেনা ওষুধ মাদক হিসেবে সেবনের বিষয়ে জেলা ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষও জানে। তারা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন দোকানে অভিযানও চালিয়েছে বলে দাবি করছে।

কয়েকজন মাদকসেবী সঙ্গে নিউজবাংলা কথা বললে তারা জানান, সকালে এবং রাতের দিকে এই ওষুধগুলো বেশি কেনেন মাদকসেবীরা। তবে এখন দোকান থেকে আর কিনতে হয় না। মুঠোফোনে বেচাকেনা করা হয় ট্যাপেন্টাডল।

নিষিদ্ধ হওয়ার আগে এই ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ছিল (প্রতি পিস) ১৪ টাকা। কিন্তু এখন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করছেন দোকানিরা।

সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা নজরদারি চালিয়ে জানিয়েছে, বগুড়ায় খান মার্কেট ও নদী বাংলা মাকের্টে ১০ থেকে ১২টি দোকান এ কাজ করে। এর মধ্যে পাঁচটি দোকান ট্যাপেন্টাডল পাইকারি বিক্রি করে। খুচরা বিক্রি করে সাতটি। তারা সকাল ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে মাদকসেবীদের কাছে এসব নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রি করে। আর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টার মধ্যেও বিক্রি বেশ রমরমা থাকে।

এসব তথ্যের ভিত্তিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক অভিযানে কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে খান মার্কেটের উত্তরণ ফার্মেসির মালিক ও একজন কর্মচারি বিপুল পরিমাণ ট্যাপেন্টাডল ওষুধসহ গ্রেপ্তার হন। বছরখানেক আগে এই দোকান মালিক একই অপরাধে দণ্ডিত হয়েছিলেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বগুড়া ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর। এ জেলার বাসিন্দাদের দেশের সব বড় শহরগুলোয় যাতায়াত আছে। পাশাপাশি বগুড়ার কাছেই ভারত সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলা রয়েছে। সেগুলোয় ট্যাপেন্টাডলসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য চোরাচালান করে অবৈধ ব্যবসায়ীরা।

পাশের জেলা জয়পুরহাটের হিলি সীমান্ত দিয়ে নিষিদ্ধ ট্যাপেন্টাডল ওষুধ সবচেয়ে বেশি চোরাচালান হয়। হিলি থেকে এসব মাদকদ্রব্য সান্তাহারে আনা হয়। সেখান থেকে বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে এই মাদকদ্র্রব্য। সম্প্রতি রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত দিয়েও ট্যাপেন্টাডল চোরাচালান করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত থেকে এই ট্যাপেন্টাডল এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও প্রবেশ করছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, বগুড়ায় গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় এ ধরনের ২৩ হাজার ওষুধ জব্দ হয়েছে।

গত জানুয়ারিতেই পুলিশের অভিযানে জব্দ হয় ৬ হাজার ৬০ পিস ট্যাপেন্টাডল। ওই ঘটনায় তন্ময় মজুমদার নামে এক শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হন। তন্ময় সদরের সাবগ্রাম চকআলম এলাকার ছেলে।

গত ১০ মার্চ শহরের চকসূত্রাপুর এলাকা থেকে ৯০৫ পিস ট্যাপেন্টাডলসহ বেহুলা নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৮ হাজার ১৩৭ পিস ট্যাপেন্টাডলের সবচেয়ে বড় চালান নিয়ে ধরা পড়েন শহরের উত্তরণ ফার্মেসির মালিক আপেল মাহমুদ। তিনি গত বছরও একই অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

র‌্যাব জানায়, গত বছরের ৯ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সংস্থাটির অভিযানে ১৫ হাজার ৭৪২টি ট্যাপেন্টাডল ওষুধ জব্দ করা হয়। এগুলোর বেশিরভাগই পাওয়া গেছে জেলার বিভিন্ন ফার্মাসিতে।

এ বিষয়ে র‌্যাব-১২ বগুড়ার কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার সোহরাব হোসেন জানান, ‘ট্যাপেন্টাডল ওষুধ ভারত সীমান্ত দিয়ে দেশের ভিতরে ঢুকছে। এ সংক্রান্ত অনেক গোয়েন্দা তথ্য আমাদের রয়েছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। ট্যাপেন্টাডল ওষুধের বিস্তারকে আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’

ট্যাপেন্টাডল ওষুধের দোকানগুলিতে গোপনে বিক্রি হলেও এ নিয়ে খুব একটা নজরদারি নেই জেলা ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। এর কারণ হিসেবে লোকবল সংকটের কথা উল্লেখ করেন বগুড়া ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শরিফুল ইসলাম মোল্লা।

তিনি জানান, ‘২০২০ সালের মার্চে ট্যাপেন্টাডল ওষুধ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলেও ওষুধটির বেচাকেনার কিছু খবর আমাদের নজরে এসেছে। বিষয়টি এখন গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। তবে আমাদের লোকবল সংকটের কারণে কিছুটা পিছিয়ে পড়ি। তারপরও খবর পেলে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নিই।’

ওষুধের দোকানে ট্যাপেন্টাডল বিক্রি ধরা পড়লে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়, জানতে চাওয়া হলে শরিফুল ইসলাম বলেন, কোনো ফার্মাসি একাধিকবার একই অপরাধ করলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে আমাদের জেলা অফিস থেকে কারো লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা নেই। আমরা ওষুধের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করতে পারি।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপরিচালক মেহেদী হাসান জানান, এটি মূলত ইয়াবার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হয়। আর নিষিদ্ধ হওয়ার পর পাশের দেশ ভারত থেকে একচেটিয়াভাবে পাচার হয়ে আমাদের এখানে আসছে।

জেলায় প্রায় ১৫টি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে অন্তত ২৩০ জন মাদকসেবী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের একটি অংশ ট্যাপেন্টাডলে আসক্ত বলে জানিয়েছে।

মেহেদী হাসান বলেন, ‘মাদকসেবীদের নিয়ে অনেক বেশি জরিপ করা প্রয়োজন। এ জন্য আমাদের জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়াতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর