‘মোরা অবৈধ জাল দিয়া মাছ ধরি এই কথা সত্য, কিন্তু এই সুযোগ তো হেরা মোগো কইর্যা দেয়। টাহা দিয়া মোরা গাঙে জাল বাই, টাহা না দেলেই তহন মোগো উপরে আইত্যার (হাতিয়ার) ধরে, জাল-মাছ-ত্যালপানি সব লইয়া যায়। জলদস্যুরা আর কি ডাকাতি করে, হ্যারা মোগো তো নিঃস্ব কইরা ফালাইছে।’
পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের হরিণঘাটাসংলগ্ন এলাকার জেলে আল-আমিন হতাশা, ক্ষোভ ও আক্ষেপ করে বলছিলেন এমন কথা।
উপকূলীয় জেলা বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা, জিনতলা, পদ্মাসহ আশপাশের সব গ্রামের বাসিন্দাদের মূল পেশা সাগর ও নদীতে মাছ শিকার। শুধু পাথরঘাটা নয়, বরগুনা জেলার তিনটি প্রধান নদ-নদী পায়রা (বুড়িশ্বর), বলেশ্বর ও বিষখালীসংলগ্ন তীরবর্তী বাসিন্দাদের সিংহভাগই পেশাজীবী জেলে। বছরব্যাপী নদীতে মাছ শিকার করে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণের জোগান দেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি নিষিদ্ধ জাল জব্দে পাথরঘাটার পদ্মার পশ্চিম খাল এলাকায় অভিযান চালায় প্রশাসন। এ সময় উত্তেজিত জেলেরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তা, কোস্টগার্ড, পুলিশসহ মৎস্য বিভাগের মাঝি-মাল্লাদের ওপর হামলা করলে আটজন আহত হন। আগেও উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় হামলার শিকার হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরগুনাসহ গোটা উপকূলের জেলেরা নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড এবং বন বিভাগকে ‘মাসোহারা’ দিয়ে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করেন। এ জন্য মাসে দুবার ছয় থেকে সাত দিন মাছ শিকারের সময় থাকে। জেলেদের ভাষায় এই সময়কে বলা হয় ‘গোন’ (অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোর আগে ও পরে তিন দিন)।
আর কোনো ‘গোনে’ কোনো জেলে টাকা দিতে ব্যর্থ হলেই তাকে ‘রেড সিগন্যালের’ আওতায় বলে চিহ্নিত করা হয়। তুলে নেয়া হয় তার জাল, মাছ ও রসদ।
জেলেরা জানান, মাসোহারা যারা দেয় তারা থাকেন গ্রিন সিগন্যালের আওতায়। অভিযানে ধরা পড়লে সোর্সরা তীরে থেকে দরকষাকষি করে টাকা নিয়ে ফোনে জানিয়ে দেয় জাল ছেড়ে দিতে।
ভুক্তভোগী জেলেরা জানান, সবচেয়ে বেশি ‘মাসোহারা’ নিয়ে মাছ ধরতে দেয় তালতলী উপজেলার সখিনা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি বন বিভাগ।
এ ছাড়া কোস্টগার্ডের সোর্স পরিচয়ে কিছু ব্যক্তি ও কোস্টগার্ডের মাঝিদের বিরুদ্ধেও জেলেদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
জেলে শাহজাহান জানান, নৌ-পুলিশকে টাকা দিয়ে তারা বিষখালী নদীর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মাছ ধরেন। প্রতি ‘গোনে’ ১ হাজার টাকা দিয়ে জাল পাতেন জেলেরা। টাকা না দিলে জাল তুলে নিয়ে যায় বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘জাল ধরলে বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিলেই জাল ছেড়ে দেয় তারা।’
জেলে নাইম বলেন, ‘১৫ দিনে মাছ অয়নায়, টাকা দেতে পারি নাই, মোর জাল হেরা লইয়া গ্যাছে। আবার যারা টাকা দিতে পারছে তারা জাল পাতছে।’
ওই এলাকার মাছ ব্যবসায়ীদের একজন ফোরকান উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘টাকা দিলেই অবৈধ জাল বৈধ হয়ে যায়। অভিযানে আসার পর জাল তুলে নৌ-পুলিশের সঙ্গে দরকষাকষি করেন জেলেরা। এরপর বিকাশে টাকা দিলেই জাল রেখে যায়, আর টাকা না দিলে জাল নিয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘‘এখানে বাহিনীর কিছু দালাল আছে, দালালদের কাছে নিয়মিত ‘গোনে’ টাকা দিতে হয়। যারা টাকা দেয় ওই জেলেদের জাল ধরে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জেলে জানান, হরিণঘাটা, বাদুরতলা, জিনতলা এলাকার জেলেদের কাছ থেকে সখিনা নৌ-পুলিশের নামে টাকা তোলেন সোহাগ মোল্লা ও কালাম মাঝি নামের দুই ব্যক্তি। এদের নম্বরে বিকাশে টাকা দিলেই জেলেরা নিরাপদে অবৈধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করতে পারেন।
এ ছাড়া ইলিয়াস মাঝি কোস্টগার্ডের নাম করে তাদের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে থাকেন বলে জেলেদের অভিযোগ।
পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের পদ্মা এলাকার জেলে আবুল বাশার বলেন, ‘মাছ ধরতে না পারায় জেলেরা টাকা দিতে পারেননি। এ কারণেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জেলেদের ওপর চড়াও হয়। এ অবস্থায় যখন অভিযান চালিয়ে জেলেদের নৌকা, নদীতীর ও বাড়িঘর থেকে জাল নিয়ে যেতে উদ্যত হয়, তখন জেলেরা ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণ চালান।’
তিনি বলেন, ‘অবৈধ জাল পাতা বন্ধ থাকলে সব বন্ধ থাকা উচিত, কিন্তু টাকা নিয়ে আবার আমাদের জাল কেড়ে নিলে সেটা সহ্য করা যায় না।’
ওই এলাকার জেলেদের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মাসে মোট সাত দিন মাছ শিকার করতে, কচিখালী, দুবলা ও শ্যাওলা এই তিন এলাকার বন বিভাগের কর্মকর্তাদের এক হাজার করে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। এরপর চরদুয়ানী নৌ-পুলিশকে ১ হাজার ও কোস্টগার্ডকে ১ হাজার করে টাকা দিতে হয়।
‘কোস্টগার্ড, স্মার্ট বাহিনী ও বন বিভাগের তিনজন স্থানীয় সোর্স আলমগীর, মান্নান ও মাসুম জেলেদের কাছ থেকে টাকা তোলেন।’
জেলেদের ওই নেতা বলেন, ‘নদীতে জাল পাতলেই সোর্সরা সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে ফোনে বিষয়টি জানায়। পরে দরকষাকষি করে টাকা হাতে পেলে সেটি জানালে নিরাপদেই মাছ ধরতে পারেন জেলেরা।’
একই কথা জানান পদ্মা এলাকার অর্ধশতাধিক জেলে।
সখিনা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম জেলেদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা গত দুই মাসে কোনো অভিযান পরিচালনা করিনি। কালাম মাঝিকে আমি চিনি, জেলেদের কাছ থেকে আমাদের নাম করে সে যদি টাকা তোলে, তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
কোস্টগার্ড পাথরঘাটা ঘাঁটির স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট হারুন-অর রশীদ বলেন, ‘আমি এখানে জয়েন করেছি দুই মাস হলো। এই দুই মাসে জেলেদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার কোনো অভিযোগ হয়তো নেই। এর আগে কে কী করেছে আমার জানা নেই। কিন্তু আমি যোগ দেয়ার পর যার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে সেই সোর্স পরিচয়দানকারী ও ট্রলার মাঝির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমি যতদিন এখানে দায়িত্বে আছি, কোস্টগার্ডের নাম করে কেউ যদি টাকা নেয়, আমি নিজে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।’
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘গত দেড় শ বছরেও তো এমন অভিযোগ শুনিনি। হঠাৎ করে জেলেদের কেন এমন অভিযোগ। আমি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে জানব। বন বিভাগের কেউ যদি টাকা নিয়ে থাকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’