বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অন্য পণ্য না কিনলে তেল নয়

  •    
  • ১১ মার্চ, ২০২২ ১৬:৩৯

কুমিল্লায় তীর সয়াবিনের ডিলার বিন্দু সাহা বলেন, ‘কোম্পানিকে বারবার তাগাদা দিয়েও তেল আনতে পারছি না। আমরা কী করব? আমরা যদি তেলের কথা জিজ্ঞেস করি, তাহলে আমাদের বলে অন্যান্য মুদি মালও সমানতালে বিক্রি করতে হবে। না হয় তেল পাওয়া যাবে না।’

রাজধানীর মতো বিভিন্ন জেলা শহরেও সয়াবিন তেল কিনতে গেলে সঙ্গে কোম্পানির অন্য পণ্য কিনতে বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

একাধিক দোকানি বলছেন, তারা অন্য পণ্য না কিনলে কোম্পানির পরিবেশকরা সয়াবিন তেল দিচ্ছেন না। আবার সর্বোচ্চ যে খুচরা দামে বিক্রি করতে হয়, সেই দামেই তেল নিতে হচ্ছে পরিবেশকদের কাছ থেকে।

পরিবেশকরা বলছেন, তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এগুলো কোম্পানি বাধ্য করছে। তাদেরও তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য নিতে হচ্ছে। ফলে তারাও মুদি দোকানিদের একই চাপ দিচ্ছেন।

ক্রেতারাও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি তেল কিনছেন বলে জানিয়েছেন বিক্রেতা।

তবে কোম্পানিকে পুরোপুরি দোষ দিতে নারাজ প্রশাসন। কারণ তাদের অভিযানে একাধিক পরিবেশকের গুদামে বিপুল পরিমাণ তেল মজুতের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

গত ১ মার্চ থেকে তেলের দাম লিটারে আরও ১২ টাকা বাড়াতে তেল বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব সরকার ফিরিয়ে দেয়ার পর বাজারে এই সংকট তৈরি হয়েছে।

কোম্পানিগুলোর দাবি, এখন বাজারে যে তেল সরবরাহ করা হচ্ছে, সেটি আগের দামের চেয়ে বেশিতে কিনে আনতে হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে। দাম না বাড়ালে তাদের পোষাবে না।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ব্যবসায়ীদের এই যুক্তির বিষয়ে কিছু না বলে রোজার জন্য সয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।

এর মধ্যে বাজারে সরবরাহ নিয়ে অস্থিতরা তৈরি হলে সরকার জুন পর্যন্ত তেলের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে কোম্পানিগুলোর খরচ কিছুটা কমে আসবে। তবে এই আদেশ এখনও জারি হয়নি।

ডিলারদের হাতে আমরা জিম্মি: মুদি দোকানি

ডিলাররা বলছেন, কোম্পানি তেল দিচ্ছে না। মুদি দোকানিরা বলছেন, তেল দিচ্ছে না ডিলাররা। আর যদিও তারা তেল দিতে রাজিও হয়, সঙ্গে আটাসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্য কিনতে হচ্ছে।

তেল নিয়ে এমনই এক জিম্মিদশা শুরু হয়েছে কুমিল্লায়।

মুদি দোকানিদের এই অভিযোগ স্বীকার করেছেন কুমিল্লায় তীর সয়াবিনের ডিলার বিন্দু সাহা। তিনি বলেন, ‘কোম্পানিকে বারবার তাগাদা দিয়েও তেল আনতে পারছি না। আমরা কী করব? আমরা যদি তেলের কথা জিজ্ঞেস করি, তাহলে আমাদের বলে অন্যান্য মুদি মালও সমানতালে বিক্রি করতে হবে। না হয় তেল পাওয়া যাবে না।’

মুদি দোকানিদের অভিযোগ, পাইকারি দামে কিনে সেই দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে সয়াবিন তেল। দুই-চার টাকা বেশি দামে বিক্রি করলেই ভ্রাম্যমাণ আদালতে জরিমানা হচ্ছে। কিন্তু তাদের কিছু করার নেই।

মুদি দোকানিরা যেমন ডিলারদের কাছে জিম্মি হওয়ার কথা বলছেন, ডিলাররা তেমনি অভিযোগ করছেন কোম্পানির বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ, কোম্পানি চাহিদা অনুয়াযী তেল সরবরাহ করছে না।

নগরীর রাজগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, মুদি দোকানে পর্যাপ্ত সয়াবিন তেল নেই। গড়ে ৫-১০ লিটার তেল সাজিয়ে রেখেছেন দোকানের শোকেসে। প্রতি লিটার বিক্রি করছেন ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকা দরে।

মুদি দোকান কেশব স্টোর্সের স্বত্বাধিকারী কেশব চন্দ্র সাহা বলেন, ‘ডিলাররা এখন তেল দিতে চাচ্ছেন না। অনেকটা জোরাজুরি করেই তাদের থেকে তেল আনতে হয়। কারণ আমাদের বেশ কিছু পরিচিত ক্রেতা আছে। তাদের জন্য পাইকারি দামে তেল কিনে পাইকারি দামেই বিক্রি করতে হয়। মাঝখান দিয়া গাড়ি ভাড়াটা আমাদের গাঁট থেকে দিতে হয়।’

আরেক দোকানি নাজমুল হাসান বলেন, ‘কোম্পানি থেকে দোকানে এসে তেল দিয়ে যায়। আজ ১৫-২০ দিন কেউ আসে না। ডিলারদের কাছে গেলেও তেল নেই বলে না করে দেয়। আমরা আছি বিপদে। আমাদের কাস্টমার ছুটে যাচ্ছে তেলের কারণে।’

আবদুর সবুর নামে আরেক দোকানি বলেন, ‘তেল নাই। কেন নাই এই কথার কোনো জবাব দিতাম পারি না। ডিলাররা তেল দেয় না। কী যে অবস্থা অইছে!’

তীর সয়াবিনের ডিলার নগরীর চকবাজারে, রাজগঞ্জে ফ্রেশের, রেলস্টেশন এলাকায় রূপচাঁদা ও চকবাজার বালুধুম এলাকায় রয়েছেন বসুন্ধরা সয়াবিনের ডিলার।

চকবাজার রাজমণি মার্কেটে বসুন্ধরার ডিলার মেসার্স বিছমিল্লাহ ট্রের্ডাসের স্বত্বাধিকারী সুলতান খানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করেন তার ছোট ভাই ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘আসলে কোম্পানি আমাদের তেল দিচ্ছে না। যার কারণে আমরা মুদি দোকানিদের দিতে পারছি না।’

অবৈধ মজুতের সন্দেহ প্রশাসনের

তবে কুমিল্লা জেলায় পর্যাপ্ত তেল মজুত আছে এবং সেই তেল বেশি দামে বিক্রি বিক্রি করার জন্য গুদামজাত করে রেখেছেন বলে সন্দেহ করছেন কুমিল্লা জেলা ভোক্তা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আছাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই আমরা অভিযান করছি। তবে আমাদের লোকবল বেশি থাকলে প্রতিটি উপজেলায় অভিযান পরিচালনা করতাম।’

ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আছাদুল তার বক্তব্যর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘সোমবার নগরীর পুলিশ লাইন এলাকায় আমড়াতলী স্টোর্সের গুদামে পাঁচ শ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করেছি। কারণ তিনি এই তেল মজুত করে বেশি দামে বিক্রি করছিলেন।’

এটা তেলসমাতি: ক্রেতা

ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ বাজারে দোকানে দোকানে খোলা সয়াবিন তেলের অভাব নেই। বোতলজাত সয়াবিন তেলও সারিবদ্ধ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তবে একেক দোকানে বিক্রি হচ্ছে একেক দামে। অতিরিক্ত দাম হওয়ায় ক্রেতারা এসে দামাদামি করছেন। ঢাকা থেকে তেল আসছে না জানালে বেশি দামেই কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা।

বাজারের সুমন অয়েল মিলস থেকে বিভিন্ন দোকানদাররা এসে পাইকারি দামে তেল কিনে নেন৷ এরপর খুচরা বিক্রি করা হয় বিভিন্ন বাজারে। মূলত এই মিলে পাইকারি দাম বাড়ানো হলে প্রভাব পড়ে আশপাশের খুচরা বাজারগুলোতে।

সারি সারি ড্রামভর্তি তেল থাকলেও তেলের দাম বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন ছিল সুমন অয়েল মিলসের মালিক আজহার আলীর কাছে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন ড্রামভর্তি তেল থাকলেও কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। ঢাকায় তেলের সরবরাহ কম থাকার অজুহাতে আমাদের কাছে বেশি দাম রাখা হচ্ছে। এজন্য আমারও আগের চেয়ে কম তেল কিনছি। আমরা কিছুটা লাভ করে পাইকারি ১৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি৷ এরপর খুচরা দোকানদাররা ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি করছে।’

দোকানি সবুজ মিয়া বলেন, ‘খোলা সয়াবিন তেল ১৯০ টাকা, পাম তেল ১৭৫ টাকা, কোয়ালিটি তেল ১৮০ টাকা কেজি, বোতলজাতকরণ সয়াবিন তেল ১৮০ টাকা লিটার। এছাড়া খোলা সরিষা ২৩০-২৬০ টাকা কেজি ও বোতলজাত সরিষা ২৬০ টাকা লিটার।’

তিনি বলেন, ‘দাম উঠানামার পিছনে আমাদের কারসাজি নেই। পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিছুদিন তেল বিক্রি না করে গোডাউনে রেখে দিলেই সরবরাহ কমে যাবে। এতে প্রভাব পড়বে সব বাজারে। এভাবে সরবরাহ কমের অজুহাতে পাইকারি দাম বাড়লে, আমরাও খুচরাভাবে বেশি দামে তেল বিক্রি করি।’

খোলা সয়াবিন তেল কিনতে আসা ফয়জুল রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তেল নিয়ে তেলেসমাতি শুরু হয়েছে। সব দোকানে একদামে তেল বিক্রি হচ্ছে না। কেউ ১৯০ টাকা, কেউ ১৮৫, আবার কেউ ২০০ টাকায় বিক্রি করছে।

আজিজুল হক নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির কারণে অনেক খারাপ কোয়ালিটির তেল বাজারে এসেছে। এসব তেল কিছুটা কম দানে কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা৷’

ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আয়েশা হক বলেন, ‘নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা গোডাউনে তেল স্টক করে রাখতে পারবে না।’

‘মাইনষের ১ লিটার লাগলে কিনছে ৫ লিটার’

হবিগঞ্জের বাজারের বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতাদের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তেল কিনছেন। এটিও সংকটের এক কারণ।

হবিগঞ্জ শহরে মুদিমালের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চৌধুরী বাজার। সেখানে আছে খুচরা দোকানও।

বাজারের জয়নিতা স্টোরের ম্যানেজার নিলয় রহমান বলেন, ‘তিন সপ্তাহ আগে মাল কিনেছিলাম। এখন ডিলারের কাছ থেকে মাল কিনতে পারছি না। বিশেষ করে পাঁচ লিটারের বোতল তেল একেবারেই নাই। আমরাও এখন খুচরা কিনে খুচরা বিক্রি করছি।’

খুচরা পর্যায়ে তেলের চাহিদাও বেড়ে গেছে বলে জানালেন এই বিক্রেতা। বলেন, যার দরকার একটা, সে নেয় পাঁচটা। তারা মনে করেন, তেলের দাম আরও বাড়বে।’

মহাদেব ভাণ্ডারের স্বত্তাধিকারী অবিনাশ রায়ও একই কথা বললেন। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মজুতের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘কে মজুত করছে না? গ্রামীণ বাজারের ব্যবসায়ীরাও তেলের মজুদ করার চেষ্টা করছেন। ক্রেতারাও মজুদ করছে। যাদের মাসে ৫ লিটার তেলের প্রয়োজন তারা দিচ্ছেন ১৫ লিটার। তেলের সংকটের কারণে মধ্যবিত্ত ক্রেতারাই বেশি দায়ী।’

ক্রেতাদের অভিযোগ- ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেল থাকার পরও বিক্রি করতে চাচ্ছেন না। আবার যারা বিক্রি করছেন তারাও নিচ্ছেন অতিরিক্ত দাম। বোতলে ১৬৮ টাকা লেখা থাকলেও ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন ১৭৫ থেকে ১৮০টাকা। আর খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা লিটার দরে।

বাজার করতে আসা বানিয়াচং উপজেলার পুকড়া এলাকার ক্রেতা মইনুল হক বলেন- ‘আমরা সাধারণ মানুষ একরকম জিম্মি হয়ে গেছি। বোতলের মধ্যে তেলের দাম দেয়া থাকলেও ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত দাম ছাড়া তেল দিচ্ছেন না।’

শহরের শ্যামলী এলাকার নাজিম উদ্দিন বলেন- ‘অনেক ব্যবসায়ী তেল দিতে চান না। আবার যারা দিচ্ছেন তারা লিটার প্রতি ৫ থোক ৮টাকা বেশি দাম নিচ্ছেন।’

মহাপ্রভু স্টোরের মালিক প্রভাংস পাল বলেন, ‘ডিলাররা তেল সরবরাহ না করার কারণে বাজারে এই সংকট দেখা দিয়েছে। অথচ সবাই দোষ দিচ্ছে আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের। ডিলাররা যদি তেল না দেয় তাহলে আমরা তেল কই পাব বলেন? আমরাওতো বেকায়দায় পড়েছি।’

মহাদেব ভাণ্ডারের স্বত্তাধিকারী অবিনাশ রায় বলেন, ‘তেল নিয়ে তো আমরা বেশি বেকায়দায়। একদিকে ডিলারদের কাছ থেকে আমরা তেল পাচ্ছি না, অন্যদিকে মজুদ করছি বলে আমাদের দুষছে সাধারণ মানুষ।’

দাম বেশি নেয়ার অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, বোতলে দাম দেয়া থাকে। বেশি নিলে ক্রেতারা ভোক্তা অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ করতে পারেন।’

তবে হবিগঞ্জ ভোক্ত অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক দেবানন্দ সিনহা জানিয়েছেন, তারা বেশি দাম রাখান প্রমাণ পেয়েছেন।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দাম বেশি রাখার বিষয়ে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। বৃহস্পতিবার সকালে শায়েস্তাগঞ্জ অভিযান চালাই। এ সময় দেখা যায় ব্যবসায়ীরা বোতল থেকে ঘষে দাম তুলে ফেলেছেন। পরে অতিরিক্ত দাম নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ গায়ের জোরেই অতিরিক্ত দাম নেওয়ার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। এ জন্য ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর