বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মৃত্যুর পরের মুহূর্ত কি আনন্দের?

  •    
  • ৯ মার্চ, ২০২২ ১৬:৫১

মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে- এমন ব্যক্তিদের দাবিগুলোকে বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনাগুলো শরীরের বাইরের অভিজ্ঞতা, গভীর আনন্দের অনুভূতি, কোনো বিদেহী আহ্বান, আলোকোজ্জ্বল আকাশ দেখার সঙ্গে সম্পর্কিত। একই সঙ্গে উদ্বেগ বা চূড়ান্ত শূন্যতা ও নীরবতার তথ্যও পাওয়া যায়।

সাধারণ ধারণা অনুযায়ী, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অকার্যকর হয়ে পড়ে মস্তিষ্ক। তবে আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়ার পরেও কিছুটা সময় সচল থাকে মগজ। থাকে অনুভবের ক্ষমতা।

যুক্তরাজ্যের ব্যাঙ্গর ইউনিভার্সিটির কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক গুইলাম থিয়েরি মনে করছেন, আরও অনেক কিছু আমাদের জানার বাকি। মৃত্যুর পর মানুষ কতক্ষণ সচেতন থাকে, সে সময়টি মস্তিষ্ক কী অনুভব করে- তা নিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন প্রখ্যাত এই স্নায়ুবিজ্ঞানী। দ্য কনভারসেসনে প্রকাশিত নিবন্ধটি অনুবাদ করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য।

আমি তখন প্রায় ১৫ বছর বয়সী কিশোর। সেই বয়সে প্রথম মৃত্যুভয়ে আক্রান্ত হই এবং মৃত্যুর অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে তা নিয়ে দুর্ভাবনা আমাকে ঘিরে ধরে। আমি তখন মাত্র ফরাসি বিপ্লবের ভয়ংকর দিকগুলো জানতে পেরেছি। গিলোটিন কী করে শরীর থেকে মাথাগুলোকে নিখুঁতভাবে কেটে ফেলে জেনে শিউরে উঠেছি।

ফরাসি বিপ্লবের নেতা জর্জেস ডান্টনকে গিলোটিনে চড়িয়ে হত্যা করা হয় ১৭৯৪ সালের ৫ এপ্রিল। মৃত্যুর আগে তার শেষ কথাটি আমার মনে গেঁথে আছে। জল্লাদকে তিনি বলেছিলেন, ‘জনগণকে আমার কাটা মাথা দেখিও, এটি হবে দেখার মতো।’

অনেক বছর পরে একজন কগনেটিভ স্নায়ুবিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পর একটি চিন্তা আমার মধ্যে তৈরি হয়। আমি ভাবতে শুরু করি, শরীর থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন একটি মস্তিষ্ক সম্ভবত আশপাশের পরিবেশ বুঝতে পারে এবং চিন্তাও করতে পারে।

ডান্টন চেয়েছিলেন তার কাটা মাথা জনগণের সামনে প্রদর্শন করা হোক, কিন্তু তিনি কি লোকদের দেখতে বা শুনতে পাচ্ছিলেন? তিনি কি খানিকটা সময়ের জন্যও সচেতন ছিলেন? কীভাবে তার মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেল?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ২০২১ সালের ১৪ জুন তারিখেও আমি প্রবলভাবে খুঁজেছি। সেদিন ফ্রান্সের মার্সেইয়ে রওনা হয়েছিলাম। কারণ আমার মা অ্যাভিগননে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে আমার ভাইয়ের অবস্থা ছিল গুরুতর। কিছুদিন আগেই ওর ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়েছে।

তবে অ্যাভিগননে পৌঁছানোর পর জানতে পারি আমার ভাই চার ঘণ্টা আগে মারা গেছে। ওর মৃতদেহটি ছিল একদম সৌম্য, নিখাদ স্থির। মাথাটি এমনভাবে খানিকটা কাত হয়ে ছিল যেন ও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কেবল শ্বাস নিচ্ছে না, সেই সঙ্গে দেহটি শীতল।

ওই দিন এবং তার পরের কয়েক মাস ধরে আমি যতই অবিশ্বাস করি না কেন, বাস্তবতা হলো, আমার ভাইয়ের অনন্য উজ্জ্বল এবং সৃজনশীল জীবনের অবসান ঘটে গিয়েছিল। কেবল রয়ে গেছে তার রেখে যাওয়া শিল্পকর্মগুলো

সেদিন আমাকে হাসপাতালের একটি কক্ষে ভাইয়ের প্রাণহীন দেহের সঙ্গে থাকতে দেয়া হয়েছিল। আমি তখন ওর সঙ্গে কথা বলার তীব্র ইচ্ছা অনুভব করেছি এবং কথা বলার চেষ্টাও করেছি।

মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে আমি ২৫ বছর অধ্যয়ন করেছি। খুব ভালোভাবে জানি, হৃৎপিণ্ড অচল হওয়ার পর মস্তিষ্কে রক্ত ​​​​সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রায় ছয় মিনিট পরে মস্তিষ্ক মূলত মারা যেতে থাকে। এই সময়ের পর অবনতির মাত্রা এমন একটি বিন্দুতে পৌঁছায় যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব নয়। আমাদের মৌলিক চেতনা, নিজেকে অনুভব করার ক্ষমতা এবং যেসব চিন্তা আমাদের নিজস্ব বলে মনে হয়- তা হারিয়ে যায়।

আমার প্রিয় ভাই মারা যাওয়ার পাঁচ ঘণ্টা পরে আমার কণ্ঠস্বর শোনার এবং চিন্তাভাবনার জন্ম দেয়ার মতো কিছু কি অবশিষ্ট ওর মস্তিষ্কে থাকতে পারে?

কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা

মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে- এমন ব্যক্তিদের দাবিগুলোকে বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনাগুলো শরীরের বাইরের অভিজ্ঞতা, গভীর আনন্দের অনুভূতি, কোনো বিদেহী আহ্বান, আলোকোজ্জ্বল আকাশ দেখার সঙ্গে সম্পর্কিত। একই সঙ্গে উদ্বেগ বা চূড়ান্ত শূন্যতা ও নীরবতার তথ্যও পাওয়া যায়। তবে এ ধরনের অভিজ্ঞতার দিকে নজর দেয়া গবেষণাগুলোর প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো, এগুলো মূলত ব্যক্তির অভিজ্ঞতার প্রকৃতির ওপর বেশি জোর দেয় এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে উপেক্ষা করে।

কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে অ্যানেস্থেশিয়ার কারণে বা আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে চেতনা হারানোর ঘটনা ঘটে। এর ফলে তাদের মস্তিষ্ক দ্রুত সক্রিয়তা হারানোয় গভীর উদ্বেগ অনুভবের জায়গা খুব কম থাকে। বিপরীতে, দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর অসুস্থতার ইতিহাস রয়েছে এমন ব্যক্তির এ ধরনের রুক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকতে পারে।

আমাদের জীবনের শেষ মুহূর্তে মস্তিষ্কে আসলে কী ঘটে তা গবেষণার সুযোগ পাওয়া সহজ নয়। তবে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে ৮৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক ক্রিয়াকলাপ পরীক্ষা করা হয়েছে। তিনি মৃগীর খিঁচুনি এবং হৃদরোগে ভুগছিলেন। পড়ে যাওয়ার পর মাথায় আঘাত পেয়ে তিনি মারা যান।

জীবন থেকে মৃত্যুর যাত্রাপথে মানবমস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে এটাই প্রথম সুনির্দিষ্ট গবেষণা। তবে এ ক্ষেত্রেও মৃত্যুর সময়ে সম্ভাব্য ‘মনের অভিজ্ঞতা’র বিষয়গুলো অত্যন্ত অনুমাননির্ভর।

গবেষকেরা আবিষ্কার করেছেন, মস্তিষ্কে রক্ত​​​​প্রবাহ বন্ধ হওয়ার পরেও আলফা ও গামা নামে মস্তিষ্কের কিছু তরঙ্গ প্যাটার্ন পরিবর্তন করে। গবেষণাপত্রটিতে লেখা হয়েছে, “আলফা এবং গামার এই ক্রিয়াকলাপ মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় প্রক্রিয়া এবং স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। এটাই সম্ভবত জীবনের ‘শেষ সাড়া’, যেটি মৃত্যুর একদম কাছাকাছি পর্যায়ে ঘটে থাকতে পারে।”

যাই হোক, সুস্থ মস্তিষ্কেও এ ধরনের ক্রিয়াকলাপ ঘটা অস্বাভাবিক নয়, এবং এর মানে এই নয় যে জীবন বিলীনের আগ মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে এমন ঝলক তৈরি হচ্ছে।

ওই গবেষণাটি আমার মৌলিক প্রশ্নটির উত্তর দেয়নি। এই প্রশ্নটি হলো, মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হওয়ার পর স্নায়বিক কার্যকলাপ পুরোপুরি বন্ধ হতে কতক্ষণ সময় লাগে? গবেষণাটিতে শুধু শেষ মুহূর্তের ১৫ মিনিটে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে মৃত্যুপরবর্তী কয়েক মিনিটের তথ্য রয়েছে।

ইঁদুরের ওপর পরীক্ষাগুলোতে দেখা গেছে, মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড পরে চেতনার অবসান ঘটে। ৪০ সেকেন্ড পর স্নায়ু সক্রিয়তার বড় অংশই অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছু গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মস্তিষ্ক অচল হওয়ার সময়ে সেরোটোনিন নিঃসৃত হয়। উত্তেজনা এবং সুখের অনুভূতি তৈরিতে ভূমিকা রাখে বিশেষ এই রাসায়নিক।

তাহলে মানুষের ক্ষেত্রে কী ঘটে? তাত্ত্বিকভাবে মানবমস্তিষ্ক পুরোপুরি মারা যেতে কয়েক ঘণ্টা সময় নেয়। এ ক্ষেত্রে মানুষকে ছয়, সাত, আট, এমনকি ১০ মিনিটের পরেও পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে।

মস্তিষ্ক মরে যাওয়ার সময় চোখের সামনে কেন জীবনের ঝলক তৈরি হতে পারে- তার ব্যাখ্যা সংক্রান্ত অনেকগুলো তত্ত্ব আমি পেয়েছি। হতে পারে এটি সম্পূর্ণ কৃত্রিম একটি প্রভাব, যা মস্তিষ্ক অকার্যকর হতে শুরু করার সময়ে আকস্মিক স্নায়বিক সক্রিয়তার বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত।

আবার হতে পারে এটি একটি শেষ প্রচেষ্টা, যার মাধ্যমে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আসন্ন মৃত্যুকে এড়ানোর চেষ্টা করছে। অথবা হতে পারে এটি আমাদের জিনের গভীরে প্রোথিত একটি চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়া হয়তো আমাদেরকে জীবনের সবচেয়ে দুঃখময় ঘটনাটি ঘটার সময়ে মনকে অন্যভাবে ‘ব্যস্ত’ রাখে।

আমার অনুমান কিছুটা ভিন্ন। হয়তো আমাদের সামনে অস্তিত্বসংক্রান্ত সবচেয়ে জরুরি দিকটি হলো, আমরা নিজেদের অস্তিত্বের অর্থটি উপলব্ধি করতে চাই। যদি তাই হয়, তাহলে, মৃত্যুর সময় চোখের সামনে জীবনের ঝলক দেখা আমাদের সেই চূড়ান্ত প্রচেষ্টার অংশ হতে পারে।

যাই ঘটুক না কেন- আমরা দ্রুত একটি উত্তর খুঁজতে চাই, কারণ আমাদের সময় শেষ হয়ে আসছে।

এতে আমরা সফল হই বা না হই বা আমরা যে বিভ্রমের জোগান পাই, তা অবশ্যই মানসিক পরামানন্দ বয়ে আনে। আশা করছি, ভবিষ্যতের গবেষণা, মৃত্যুর পরে স্নায়ুর ক্রিয়াকলাপের দীর্ঘ সময়ের পরিমাপ, এমনকি মস্তিষ্কের ইমেজিং- আমার এই ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করবে।

এটি আমার ভাই এবং আমাদের সবার জন্যই হয়তো সত্যি, তা মিনিট বা ঘণ্টা যতটুকু সময় ধরেই স্থায়ী হোক না কেন।

এ বিভাগের আরো খবর