সতেরো বছর বয়সে ঠাকুরগাঁওয়ের বায়েজউদ্দীন আহম্মেদ কাঁধে তুলে নেন ফেরির ভার। এখন বয়স সাতষট্টি। অর্ধশতাব্দী ধরে এভাবে ভার কাঁধে গ্রামে-গঞ্জে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করেন দস্তা ও স্টিলের তৈরি হাঁড়ি-পাতিল।
বড় সংসার সামলাতে হিমশিম খাওয়া বায়েজউদ্দীন আধুনিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি নিজেকে। অনটনের দৈনন্দিন জীবনে হয়নি সঞ্চয়। বয়সের ভারে ঠিকমতো হাঁটতে না পারলেও কিছুক্ষণ পর পর বিশ্রাম নিয়ে আবারও চলেন ফেরি করে।
মঙ্গলবার দুপুরে তপ্তরোদে হাঁটার পর শহরের টাঙ্গন নদীর সেতুতে ভারসহ বসে থাকতে দেখা যায় বায়েজউদ্দীনকে। এ সময় কথা হয় নিউজবাংলার সঙ্গে।
ঠাকুরগাঁও পৌরসভার আর্টগ্যালারি মুন্সিপাড়া গ্রামে থাকেন বায়েজউদ্দীন আহম্মেদ। পরিবারে রয়েছে বৃদ্ধা স্ত্রীসহ পাঁচ ছেলে-মেয়ে। তাদের একজন কাপড়ের ফেরি করেন, অন্যরা শ্রমিক।
বায়েজউদ্দীন বলেন, ‘জেলায় এখন তেমন আর ফেরিওয়ালা নেই। একটা সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ ফেরি করতে আসত। আমরা ঠাকুরগাঁও সদরে ৫০০ জনের বেশি মানুষ হেঁটে হেঁটে ফেরির মালামাল বিক্রি করতাম। কিন্তু এখন এইভাবে আর কেউ ফেরি করে না। অনেকেই ভ্যান, অনেকে আবার সাইকেলে করে ফেরি করছে। তাদের সংখ্যাও বেশি না।
‘আমার বয়সী যারা ছিলেন তাদের মধ্যে শুধু আমিই হেঁটে ফেরি করছি। আর কুলাতে পারি না। জীবনের সবটুকু সময় শেষ, শরীরে রোগও আছে। কোন গ্রামে মরে পড়ে থাকি তার ঠিক নেই। ৫০ বছর ধরে হাঁটছি ভার নিয়ে, আর কত?’
তিনি বলেন, ‘সদর উপজেলার এমন কোনো ইউনিয়ন নেই যে এক সপ্তাহের মধ্যে হেঁটে শেষ করিনি। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটেছি। কিন্তু এখন তিন কিলোমিটার রাস্তাও হাঁটতে পারি না।
‘এদিকে সন্তানদেরও অভাবের সংসার আবার জিনিসপত্রের যা দাম। এসব কারণে শরীর না চললেও বের হতে হয়। দিনে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা যা লাভ তা দিয়ে বাড়িতে বুড়ির (স্ত্রী) ও নিজের ওষুধটুকু হয়।’
টাকা থাকলে একটি ছোট্ট দোকান দেয়ার স্বপ্ন বায়েজউদ্দীনের। এমন স্বপ্ন তো ৫০ বছরেও পূরণ হয়নি। এরপরও স্বপ্ন দেখা থেমে থাকে না তার। বলেন, ‘বুড়ি আর আমি শেষ বয়সে দোকানে বসে কাটাব।’
কিছুক্ষণ পর পর বিশ্রাম নিয়ে বায়েজউদ্দীন আবারও চলেন ফেরি করে। ছবি: নিউজবাংলা
হঠাৎ পাড়া গ্রামের ক্রেতা মহসিনা বেগম বলেন, ‘আগে এমন ফেরিওয়ালারা দিনে ছয় সাতবার আসত। এখন অনেক দোকান হওয়ায় কেউ আসে না। অনেকেই আবার ভ্যান নিয়ে আসে মাঝেমধ্যে, তারা সবাই যুবক। কিন্তু বায়েজউদ্দীন চাচা এই বয়সে ভারী একটা ফেরি কাঁধে নিয়ে হাঁটেন, দেখে খারাপ লাগে।’
গ্রামের বাসিন্দা মিরাজ উদ্দীন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখছি তাকে ফেরি করে ঘুরতে। এখন সব আধুনিক হয়েছে, মাইক বা সাউন্ডবক্স লাগিয়ে ভ্যান রঙিন আলোতে সাজিয়ে ফেরি করছে। কিন্তু বায়েজিদ চাচা একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এই বয়সে ফেরি করছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা যুবকরা চাচাকে একটি ভ্যান কিনে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি নেননি। বয়সের কারণে তিনি সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না জানিয়েছিলেন। পরে ভেবে দেখলাম চাচার একটি ছোট্ট দোকান হলে ভালো হবে। আমরা সবাই সহযোগিতা করে চাচার স্বপ্নটা পূরণ করতে পারি। প্রশাসন কিছুটা সহযোগিতা করলে তার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব।’
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহম্মদ শামসুজ্জামান বলেন, ‘বৃদ্ধ বয়সে এমন কাজ সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত। সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে আমরা তাকে দেয়ার চেষ্টা করব। আর তার দোকানের স্বপ্ন পূরণে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।’