তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ধারণাকে বিএনপি ধ্বংস করেছে বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, এই সরকারব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে বিএনপি বারবার নানা ধরনের চতুরতা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বারবার বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছেন। অথচ বিএনপিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে এবং পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে বিএনপি বারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।’
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরের বছরের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ১৯৯৪ সালে ঢাকার মিরপুর ও মাগুরায় দুটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগসহ সে সময়ের বিরোধী দলগুলো।
আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচন হয়। তাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে এসেও বিএনপি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। একপর্যায়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরব্যবস্থা করে আবার জাতীয় নির্বাচন দেয়।
তখন সিদ্ধান্ত হয়, সবশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। তিনি রাজি না হলে সব দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে একজন হবেন এই সরকারের প্রধান। আর আলোচনায় কাউকে পাওয়া না গেলে হবেন রাষ্ট্রপতি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সেই ভোটে জিতে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ২০০১ সালে।
ওই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জিতে বিএনপি-জামায়াত জোট আসে ক্ষমতায়। তবে সেই সরকারের আমলে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানো নিয়ে তৈরি হয় রাজনৈতিক বিরোধ।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা হয় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের। তিনি এককালে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ফলে তাকে মেনে নিতে রাজি ছিল না আওয়ামী লীগ।
আন্দোলনের একপর্যায়ে কে এম হাসান জানান তিনি এই পদের জন্য আগ্রহী নন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদে কে আসবেন, এ নিয়ে বিরোধের মীমাংসা না হওয়ার পর বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের ওপর বর্তায় সেই দায়িত্ব।
ইয়াজউদ্দিনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট যায় আন্দোলনে। কিন্তু একবার পিছিয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়।
একতরফা নির্বাচনের দিকে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ভোটের ১১ দিন আগে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। ইয়াজউদ্দিন আহমেদ জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ ছেড়ে দেন। দায়িত্ব নেন ফখরুদ্দীন আহমেদ।
সেই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভোট দেয়। সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে এই সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজন রিট আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় রিট আবেদনকারী পক্ষ। ২০১০ সালের ১১ মে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় পাল্টে এই সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে। তবে এর আওতায় আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেয়া হয় বলে সে সময় আইনজীবীরা জানিয়েছিলেন।
পরে প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে দুটি নির্বাচনের সেই কথা উল্লেখ ছিল না।
আপিল বিভাগের সেই আদেশের ওপর ভিত্তি করে ওই বছরের ২৪ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়।
এরপর দুটি নির্বাচন নির্বাচিত সরকারের অধীনে হয়। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোট বর্জন করলেও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তবে এবার নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ছাড়া ভোটে না আসার ঘোষণা আছে তাদের। দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামার হুমকিও এসেছে।
তবে বিএনপির দাবি পূরণ হওয়ার নয় বলে সাফ জানিয়ে দেন ওবায়দুল কাদের। বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ীই এ দেশের সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে এবং যথাসময়েই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে।
‘বিএনপি যদি তথাকথিত আন্দোলনের নামে এ দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং আবারও ২০১৩-১৪-১৫ ও ২০১৮ সালের মতো অগ্নিসন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড করতে চায়, তাহলে তাদেরকে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।’