উম্মে শায়লা। রাজবাড়ী থেকে মাস্টার্স শেষ করে গত জানুয়ারি মাসে ঢাকায় আসেন। ওঠেন এক আত্মীয়র বাসায়। ফেব্রুয়ারি মাসেই বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে তার চাকরির সুযোগ হয়। এরপরই স্বাধীনভাবে থাকার ইচ্ছা।
মিরপুরে ছোট্ট একটা রুম ভাড়া নেন শায়লা। বলেন, বাসা ভাড়া নিতে তাকে বাড়িওয়ালার নানান প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়িওয়ালাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি বিপদের কারণ নই, দুই মাস পরীক্ষামূলক থাকার সুযোগ দিয়ে দেখুন।’
শায়লার মতোই তাসনুভা চৌধুরীও এই শহরে থাকছেন নারীদের একটি মেসে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন এক বছর।
ফার্মগেটের রাজাবাজারে থাকা তাসনুভা বলেন, ‘তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটে আমরা চার কর্মজীবী নারী থাকি। বাড়িওয়ালা মেয়েদের ভাড়া দেবেনই না। কেন দেবেন না, জানতে চাইলে নানান যুক্তি দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরাই জয়ী হই। প্রায় এক বছরে ভালোই আছি।’
শায়লা ও তাসনুভার মতো নারীদের ঘুরে দাঁড়াবার অনেক গল্পই এখন স্পষ্ট।
রাজধানীতে এখন কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন নারী। কিন্তু তাদের নিরাপদ আবাসন সীমিত। শহরে একজন পুরুষের বাড়ি ভাড়া পাওয়া যতটা সহজ, নারীর জন্য তা ততটা সহজ নয়।
প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে নিজের অবস্থান শক্ত করে নিচ্ছেন নারী। কর্মসংস্থানের সঙ্গে নিশ্চিত হওয়া চাই আবাসন ব্যবস্থাও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১০ বছর আগেও নারীদের একা থাকা সমাজে আড়চোখে দেখা হতো। কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গি এখন অনেক পাল্টেছে। এখন একজন নারী একা বা অনেকে মিলে একটি বাসা ভাড়া করে থাকেন। নাগরিক হিসেবে নারীরাও স্বপ্ন দেখেন স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আসেনি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শরমিন্দ নিলোর্মি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একাকী বা কয়েকজন নারীকে বাসা ভাড়া দেয়ার মানসিক প্রস্তুতি এখন বাড়িওয়ালাদের থাকে বটে, তবে অধিকাংশ বাড়িওয়ালাই বাসা ভাড়া দিতে চান না। বিশেষ করে শুধু সন্তান নিয়ে থাকবেন এমন ৪০ বছরের ওপরে নারীকে বাড়ি ভাড়া দিতে চান না বাড়িওয়ালারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে নারীর আর্থিক অবস্থানও যাচাই করতে চান মালিকরা। বাড়িওয়ালা যদি নিশ্চিত হতে পারেন যে প্রতি মাসের ভাড়া ঠিকঠাক পাবেন, তবে অনেকে ভাড়া দিতে আপত্তি করেন না। সে ক্ষেত্রে তারা নারীর পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেন। বাড়িওয়ালার সামাজিক অবস্থান যেন ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত হতে চায়।’
বাড়ি ভাড়া এখন পাওয়া যায়
মিরপুর শেওড়াপাড়ার ছয় তলা বাসার মালিক সামাদ মোল্লা জানান, তার ফ্ল্যাটের পঞ্চম তলায় দুজন নারী একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন। তারা দুজনই কর্মজীবী। আগে মেয়েদের ভাড়া দিতেন না। তবে এখন কর্মজীবী পেয়েছেন বলে ভাড়া দিয়েছেন। কিন্তু তিনি শুধু নারী শিক্ষার্থীদের ভাড়া দেবেন না।
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছাত্রীরা পরিবারের সঙ্গে ছাড়া একা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকলে অনেক সমস্যা হয়। ৫/৬ জন ছাত্রী একসঙ্গে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেও সবার আর্থিক অবস্থা তো সমান নয়। অনেক ক্ষেত্রে ভাড়ার টাকা পেতে দেরি হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে বাড়ি চলে যায়। তখন মাসের পর মাস ভাড়া আদায় কঠিন হয়ে যায়।’
একই এলাকায় বাড়িওয়ালা রিপন মিয়ার চিন্তাভাবনা আবার অন্য রকম। তিনি বলেন, এক মাস ফ্ল্যাট খালি পড়ে থাকার চেয়ে ভাড়াটিয়া পেলেই ভাড়া দেয়া ভালো। তার সাত তলা বাসার সব ফ্ল্যাটেই পরিবারসহ সবাই থাকেন। এ জন্য ব্যাচেলর পুরুষদের ভাড়া দেন না। জানান, শিক্ষার্থীদের তিনি কখনই ভাড়া দেননি। কারণ, অন্য পরিবারগুলো অভিযোগ করে। তবে, ছাত্রী বা কর্মজীবী নারীদের বাসা ভাড়া দেন। এখনও দুটি ফ্ল্যাটে নারীরা রয়েছেন।
তবে অবিবাহিত নারীদের বাড়ি ভাড়া দেয়া হয় না বলে জানান আরেক বাড়িওয়ালা সোনিয়া খাতুন। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার জন্য সব দিকে খেয়াল রাখতে হয়। অনেক সময় বিভিন্ন সমস্যা হয়। এত সমস্যা কে নিতে চায়? এ জন্য অবিবাহিত মেয়েদের কখনো বাসা ভাড়া দিইনি।’
অনলাইনে বাড়িভাড়া
রাজধানীতে এখন দেয়ালে দেয়ালে বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে।
এসব লিফলেটে মাঝে মাঝে উল্লেখ দেখা যায়: ‘নারী রুমমেট আবশ্যক’।
তবে বাসা ভাড়া বা বসবাসের এলাকা বদল করার ক্ষেত্রে এখন আর রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এ-পাড়া, ও-পাড়া ঘুরতে হয় না। অনলাইনে খোঁজ পাওয়া যায়। রাজধানীতে বাড়ি ভাড়ার সন্ধান দিতে কাজ করছে অন্তত ২০টি অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বিপ্রোপার্টি, পিবাজার, লামুদি, বাসাভাড়াবিডিডটকম, প্রপার্টিইনবিডি, মাইরেন্টবিডি, এনিটুলেট, বিক্রয়ডটকম উল্লেখযোগ্য।
এসব প্রতিষ্ঠান ভাড়াটে বা ক্রেতার এবং ভবনমালিকের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। ভোগান্তি ছাড়া স্বল্প সময়ের মধ্যে বাজেট অনুযায়ী পছন্দের বাসা ভাড়া এবং অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য স্থান কেনাবেচার সুবিধা পাওয়া যায় এর মাধ্যমে। উভয় পক্ষই জানাতে পারে তাদের চাহিদার কথা। এলাকা, বাসার সাইজ, ভাড়ার পরিমাণ বা বাজেট অনুযায়ী পছন্দের বাসা বেছে নেয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে।
বিপ্রোপার্টির মাধ্যমে উত্তরায় বাসা ভাড়া নিয়েছেন বেসরকারি ব্যাংকে চাকরিরত নুসরাত জাহান। তিনি বলেন, ‘আগে মিরপুর থাকতাম। জানুয়ারিতে চাকরি পাওয়ার পর উত্তরায় পোস্টিং দেয়। কিন্তু অফিস করে উত্তরা গিয়ে তো বাসা খোঁজা সম্ভব না। পরে অনলাইনে খোঁজ করি এবং পেয়েও যাই। এখন ছয়জন মিলে তিন রুমের একটা বাসায় থাকি।’
থাকার স্বাধীনতা চায় নারী
পুরুষের ওপর নির্ভর হয়ে থাকতে চান না অনেক নারী। তারা একা থাকতে চান। নিজের জীবন এবং সময়কে নিজের মতো করে সাজাতে চান। জীবনকে উপভোগ করতে চান।
সঙ্গীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর থেকে ছয় বছরের সন্তান নিয়ে একাই থাকছেন শারমিন আক্তার। প্রায় ছয় বছর পেরোলেও একা থাকতে এখনও নানাজনের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় তাকে।
অনেকটা নিরাশ কণ্ঠে শারমিন বললেন, ‘স্বাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের টিকে থাকা অনেক কষ্টের। বাড়ির মালিকরা একা মেয়েদের ভাড়া দিতে চান না। অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। অফিস থেকে কখন ফিরছি, কোথায় যাচ্ছি, মাঝে মাঝে এগুলোও জানতে চান। স্বাধীনভাবে থাকা যায় না।’