জন্মলগ্ন থেকে সমাজ সভ্যতার চাকা পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। নারীরাও ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন আপন মহিমায়। দেশের শিক্ষা, কৃষি বা অর্থনীতি সর্বত্র নারীর পদচারণ রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজও নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করলেও বেতন ও মজুরি বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে শত চেষ্টার পরও বের হতে পারেননি শেরপুর ও পঞ্চগড়ের নারীরা।
মজুরি-বেতন বৈষম্যের শিকার শেরপুরের নারীরা
সমাজ ও মানুষের উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। তাদের কাজের পরিমাণ ও মান পুরুষদের মতো বা ক্ষেত্রবিশেষে বেশি হলেও মজুরি বৈষম্য থেকে মুক্তি মেলেনি শেরপুর জেলার কয়েক শ চাতালের নারী শ্রমিকদের।
জানা গেছে, খাদ্য ও কৃষিসমৃদ্ধ অঞ্চল শেরপুরে ছোট-বড় এক হাজার চাতাল ছিল। নানা কারণে এর ৮০ ভাগ চাতাল বন্ধ হয়ে যায়। চাতালগুলোতে প্রায় ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক ছিলেন। তাদের অনেকে বেকার হয়ে যান।
বাকি চাতালগুলোতে শত শত নারী শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করলেও দিনে মাত্র ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা মজুরি পান। অথচ সমপরিমাণ শ্রম দিয়েও পুরুষরা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি পান। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে কম মজুরি পাচ্ছেন হাজিরাভিত্তিক ধানের চাতালে কাজ করা নারীসহ অন্য নারী শ্রমিকরা।করোনাকালে কাজ না থাকায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে তাদের। অনেকের ঘরে পৌঁছেনি সরকারি সাহায্যও। জীবিকার তাগিদে মাঠেঘাটে কাজ করা নারীরা প্রতি বছর তাদের এই দিবস পালিত হলেও এ বিষয়ে কিছুই জানেন না তারা।রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাঠঘাটে কাজ করার পরও মজুরি বৈষম্যের শিকার নারীরা ক্ষুব্ধ। আলু ক্ষেতে কাজ করা মছিরন বেগম বলেন, ‘কাম করলে খাওয়া জোটে কপালে। আমরা গরিব মানুষ। করোনার সময় চেয়ারম্যান, মেম্বারগর কাছে তো কিছুই পাই না। ভোটের সময় খালি ভোট নেয়।’
আলু ক্ষেতে কাজ করা শ্রমিক আইবানু বলেন, ‘আমরা যহন যেই কাম পাই, ওইডাই করি। এহন আলু তুলতাছে তাই এনো কাম করতাছি। ২৫ বছর আগে ৩০ টাহা থাইক্কা কাম শুরু করছি। তহন জিনিসপত্রের দাম কম আছিল। আর এহন ২০০ টাহা দিন হাজিরা কাম কইরাও সংসার চালাবার পাই না।’সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শেরপুর শহরের ঢাকলহাটি, শীতলপুর, দিঘারপাড় ও নওহাটা এলাকার বেশ কয়েকটি ধানের চাতালে পুরুষের সঙ্গে নারী শ্রমিকরাও ধান শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
ধানের চাতালে পুরুষের সঙ্গে নারী শ্রমিকরাও কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন। ছবি: নিউজবাংলা
নওহাটার চাতাল শ্রমিক অজুফা বলেন, অনেক আগে থেকে চাতালে কাজ করি। আগে কাজের অভাব ছিল না। এখন মিল কমে যাওয়ায় কাজও কমেছে। সপ্তাহে তিন দিন বসে থাকি। এক দিন কাজ করলে ২০০ টাকা পাই। ওই টাকা দিয়ে এক দিনই চলে না, তিন দিন কীভাবে চলবে?’
‘আপনাদের কাছে শুনলাম কাল নারী দিবস। এ দিবসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি, আমরা কাজে পুরুষের সমান বেতন চাই।’খোয়ারপাড় এলাকার চাতালশ্রমিক রিতা বলেন, ‘মিল বছরে সাত মাস চলে, পাঁচ মাস বন্ধ থাকে। তাই মজুরি বাড়লে আমাদের জন্য ভালো হতো। আগে আমাদের সঙ্গে অনেক শ্রমিক কাজ করতেন। এখন কাজ কম, তাই শ্রমিকরাও কাজ কম পান।’পুরুষের সমান শ্রম দিয়েও বেতন বৈষম্যের শিকার হওয়ায় ক্ষুব্ধ নারী নেত্রীরাও। তারা চান সঠিক বেতন যেন পান নারী শ্রমিকরা।শেরপুর জেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান নাসরিন বেগম ফাতেমা নিউজবাংলাকে বলেন, জেলায় নারীরা বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করেন। এখানে নারী-পুরুষ একই কাজ করেন কিন্তু তাদের বেতন বৈষম্য অনেক।
তাই সরকারের কাছে দাবি, নারীরা যেন তাদের নায্য মজুরিটা পান।তবে মালিকরা লাভবান না হলে বেতন বাড়াবে কীভাবে জানিয়ে প্রশ্ন তোলেন এক ব্যবসায়ী নেতা।
শেরপুর চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও জেলা মিল মালিক সমিতির সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান রওশন বলেন, জেলার অধিকাংশ চাতাল-মিলই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়েছেন। আমরা সরকারের কাছে ব্যাংকঋণের সুদ মওকুফের দাবি জানাচ্ছি, যাতে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারি।
‘এখন নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য তেমন নেই। পুরুষ শ্রমিকরা বস্তা টানার মতো ভারী কাজগুলো করেন, যেগুলো নারীরা করতে পারেন না। তাই পুরুষদের ২০ থেকে ৫০ টাকা বেশি দেয়া হয়।’
পঞ্চগড়েও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত নারীরা
পঞ্চগড়েও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত পাথর কোয়ারি, বালু কোয়ারি, চা বাগানসহ বিভিন্ন কারখানায় কাজ করা প্রায় ২০ হাজার নারী শ্রমিক।
পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করলেও মজুরি বৈষম্য মেনে নিয়েই কাজ করছেন তারা।
সংসারে অভাব, বিয়েবিচ্ছেদ, ঋণের কিস্তি পরিশোধসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাবান্ধা বন্দর, তেঁতুলিয়া, ভজনপুর এবং সদর উপজেলায় নারীদের একটি বড় অংশ বেঁচে থাকার তাগিদে সস্তায় তাদের শ্রম বিক্রি করছেন।
পাথর ভাঙা মেশিনের প্রচণ্ড শব্দ ও ধুলার বলয়ে কাজ করতে গিয়ে শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগে ভুগছেন তাদের অনেকে। কিন্তু পেটের তাগিদে করতে হচ্ছে তাদের এই কঠিন কাজ। এসব নারী শ্রমিকের আক্ষেপ, পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করার পরেও তাদের দেয়া হচ্ছে কম মজুরি।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের পাথর কোয়ারিতে কাজ করা মরিয়ম, শাহেরা, আকলিমা ও নুরজাহান জানান, সংসারে অভাব থাকায় পাথর ভাঙার কাজ করছেন তারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করার পরেও তাদের পুরুষের চেয়ে মজুরি কম দেয়া হয়।
বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কুদরত-ই-খুদা মিলন বলেন, ‘নারীরা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা পার করে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছেন। মানবিক কারণেই তাদের মজুরিতে বৈষম্য করা উচিত না।’
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আধুনিক জীবনমানের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর পদচারণ চোখে পড়ার মতো। সমাজের প্রতিটি অংশে নারীদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে সরকার নিয়েছে ব্যাপক পদক্ষেপ। সমাজের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’