বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘আমার বাবারে আইন্যা দেও’

  •    
  • ৮ মার্চ, ২০২২ ১৪:৩০

সবার প্রিয় ছিলেন আজহারুল। ছিলেন খুব মিশুক। বাড়িতে এলে সবার খোঁজখবর নিতেন। মেধাবী এই তরুণ গান শুনতেন। কবিতা পড়তেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডেও ছিলেন সক্রিয়। এসব কারণে এলাকাবাসীর দৃষ্টি কেড়েছিলেন।

দরিদ্র বাবা-মার একমাত্র ছেলে আজহারুল। স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষা নিয়ে মা-বাবার দুঃখ ঘোচানোর। তাই লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নিতে একটি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থায় চাকরিও নিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু জীবনসংগ্রামী আজহারুল ও তার বাবা-মার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। যন্ত্রযান কেড়ে নিয়েছে আজহারুলকে। তার বাড়িতে এখন চলছে কান্নার রোল।

আজহারুলের পুরো নাম আজহারুল চৌধুরী, ডাকনাম অমিত। নেত্রকোণার খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দিপুর গ্রামের রিটন চৌধুরী ও আমেনা বেগমের ছেলে।

২২ বছর বয়সী আজহারুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। পাশাপাশি চাকরি করতেন কুমিল্লার দেবীদ্বার এলাকায় রুরাল রিসোর্স ফাউন্ডেশন (আরআরএফ) নামে একটি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থায়।

সোমবার সন্ধ্যায় নিজ বাইসাইকেলে চড়ে কুমিল্লার কোম্পানিগঞ্জ থেকে ঋণের কিস্তি আদায় করতে যাচ্ছিলেন আজহারুল। দেবীদ্বার পৌরসভার চাপাননগর বালুর মাঠ এলাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী একটি বহুজাতিক কোম্পানির কাভার্ডভ্যান (ঢাকা মেট্রো উ-১২-০২০০) পেছন থেকে তাকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি।

কুমিল্লা থেকে মঙ্গলবার সকালে খালিয়াজুরীর মেন্দিপুর গ্রামের বাড়িতে তার মরদেহ নেয়া হয়। লাশবাহী গাড়িটি পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আজহারুলকে শেষবারের মতো এক নজর দেখতে ভিড় করেন মেন্দিপুর ও আশপাশের গ্রামবাসী।

তারা জানান, সবার প্রিয় ছিলেন এই তরুণ। ছিলেন খুব মিশুক। বাড়িতে এলে সবার খোঁজখবর নিতেন। মেধাবী আজহারুল গান শুনতেন। কবিতা পড়তেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডেও ছিলেন সক্রিয়। এসব কারণে এলাকাবাসীর দৃষ্টি কেড়েছিলেন তিনি।

আজহারুলের চাচা কানন চৌধুরী বলেন, ‘শৈশব থেকেই মেধাবী ছিলেন আজহারুল। স্থানীয় শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে নেত্রকোণার আবু আব্বাছ ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করে চেষ্টা করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু অর্থাভাবে কোচিং করতে পারেননি।

আমি যখন ময়মনসিংহে থাকতাম তখন সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং করতে গিয়েছিল আজহারুল। একদিন এসে বলল, অর্থাভাবে কোচিং করতে পারছে না। শোনার পর আজহারুলসহ ৯ জনকে আমি কিছুদিন পড়িয়েছি এবং গাইড করেছি। এরপরই সে মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজে চান্স পায়।

নিজের অক্লান্ত চেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মিরপুর বাংলা কলেজে ভর্তি হন। এরমধ্যে আবার করোনাপরিস্থিতি চলে আসে। অর্থসঙ্কটে পড়ে যায় পরিবারটি।

সংসার ও লেখাপড়ার খরচাদি চালিয়ে যেতে পারছিল না। পারিবারিক অবস্থা একেবারেই হত দরিদ্র। তার বাবা একজন কৃষি শ্রমিক। বাড়িভিটা ছাড়া তেমন জমিজমা নেই।

দুই বোনের মধ্যে বড় সোনিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটবোন তন্বী ১০ম শ্রেণিতে পড়ে। এ অবস্থায় নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগানোর পাশাপাশি পরিবারেরও কিছুটা হাল ধরতে চেয়েছিলেন আজহারুল। তাই এনজিও সংস্থায় ক্ষুদ্রঋণ কর্মীর চাকরি নিয়েছিলেন। চাকরি করেও চালিয়ে যাচ্ছিলেন লেখাপড়া।

মেন্দিপুর গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষক শিহাব আহমেদ বলেন, ‘আমি যখন ময়মনসিংহে থাকতাম তখন সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং করতে গিয়েছিল আজহারুল। একদিন এসে বলল, অর্থাভাবে কোচিং করতে পারছে না। শোনার পর আজহারুলসহ ৯ জনকে আমি কিছুদিন পড়িয়েছি এবং গাইড করেছি। এরপরই সে মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজে চান্স পায়।’

ছেলেটি খুব সংগ্রামী এবং মেধাবী উল্লেখ করে শিহাব বলেন, ‘লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পারলে সে ভালো কিছু করতে পারতো।’

পাশ্ববর্তী সাতগাঁও গ্রামের বাসিন্দা প্রাথমিক শিক্ষক আজহার মাহমুদ বলেন, ‘আজহারুল গান, কবিতা প্রভৃতি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পছন্দ করতো। খুব স্বপ্নবাজ তরুণ ছিল। তার মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’

আজহারুলের মৃত্যুতে মিরপুর বাংলা কলেজের সহপাঠী এবং তার বন্ধুরাও কাঁদছেন।

উজ্জ্বল সরকার নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘কিছুদিন আগেও কলেজে এসেছিল আজহারুল। আমার রুমে এসে আমাদের সবার খোঁজখবর নিয়ে গেছে। সে ক্যাম্পাসে সবার সঙ্গে মিশতে পারতো। সবসময় হাসিখুশিতে থাকতো। লেখাপড়া শেষ করে ভালো একটা চাকরি করার স্বপ্ন দেখতো সে।’

মঙ্গলবার সকাল ৯টায় মেন্দিপুর পূর্বপাড়া জামে মসজিদে আজহারুলের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পারিবারিক কবরস্থানে করা হয় দাফন। এ সময় তার বাবা-মাকে সান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না কেউ। তাদের কান্না দেখে কাঁদছিলেন গ্রামের অন্যরাও।

আজহারুলের মা আমেনা বেগম পুত্রশোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। আবার জ্ঞান ফিরলেই আর্তনাদ করছেন, ‘আমার বাবারে আইন্যা দেও।’

পুত্রহারা রিটন চৌধুরী বলছেন, ‘আমার বাবা আমারে কইছিন, আর কিছুদিন কষ্ট কর বাবা। আমার লেহাপড়াডা শেষ অইলেই আমরার দিন ঘুইর‌্যা যাইব। অহন আমার বাবা কই গেল গা। আমারে থইয়া কই গেল গা। আমার বাবারে আইন্যা দেও।’

এ বিভাগের আরো খবর