মা-বাবাহারা মর্জিনা বেগম বড় হন নানা-নানির কাছে। ১৩ বছর বয়সেই তারা তার বিয়ে দিয়ে দেন। মাদকাসক্ত স্বামী কিছুদিন পর তাকে ছেড়ে চলে গেলে আবার নানার বাড়িতেই ফিরে আসেন মর্জিনা।
নানার মৃত্যুর পর শুরু করেন পিঠা বিক্রি। ভাগ্যের ফেরে একসময় তার জায়গা হয় যৌনপল্লিতে। তবে হারিয়ে যাননি ফরিদপুরের সেই মর্জিনা। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি এখন যৌনপল্লির নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন।
৫৬ বছর বয়সী মর্জিনা জানান, পিঠা বিক্রি শুরুর কিছুদিন পর এক দালালের খপ্পরে পড়ে সিরাজগঞ্জের একটি যৌনপল্লিতে বিক্রি হয়ে যান। সেখান থেকে ১৯৮৮ সালে চলে আসেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে।
যৌনপল্লিতে নানা রকম কষ্টে তাদের দিন পার করতে হতো। যৌনপল্লির শিশুরাও বঞ্চিত সব রকমের সুযোগ-সুবিধা থেকে। যৌনকর্মী ও এই শিশুদের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকে ১৯৯৮ সালে গড়ে তোলেন মুক্তি মহিলা সমিতি (এমএমএস)।
১২ জনকে নিয়ে শুরু হয় সংগঠনের কার্যক্রম। যৌনকর্মীদের জানাজা হতো না, তারা স্যান্ডেল পরতে পারতেন না। মর্জিনা তাদের এসব নিয়ে প্রতিবাদ করতে উৎসাহিত করেন। স্থানীয়দের বাধা পেয়েও তিনি সংগঠন বন্ধ করেননি।
১৯৯৯ সালে তার সংগঠন সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন পায়। এরপর কর্মজীবী কল্যাণ সংস্থার সহযোগিতায় চলতে থাকে মুক্তি মহিলা সমিতি। ১০ বছর পর ২০০৯ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিষয়ের দপ্তরে এবং ২০১৮ সালে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে নিবন্ধিত হয় সংগঠনটি।
সংগঠনের সভাপতি মর্জিনা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানে এখন ডে কেয়ার ও নাইট কেয়ার মিলিয়ে ১৬২ জন শিশু আছে। তাদের বয়স তিন থেকে ছয় বছরের মধ্যে। আমরা তাদের খাওয়াদাওয়া, পড়ালেখা, খেলাধুলা সবকিছুই দেখি। যৌনপল্লি ছাড়া আশপাশের দরিদ্র পরিবারের শিশুরাও এখানে এসব সুবিধা পায়। ছয় বছর হলে এই শিশুদের স্কুলে ভর্তি করা হয়।’
শিশুদের দেখাশোনার জন্য এখানে ৪২ জন কর্মী আছেন। তাদের মধ্যে সাতজন পুরুষ, বাকিরা নারী।
মর্জিনা জানান, মুক্তি মহিলা সমিতির চিলড্রেন সোসাইটিতে যৌনপল্লির কিশোর-কিশোরীদের কম্পিউটার শিক্ষা ও ড্রাইভিং শেখানো হয়। যৌনকর্মীদের শেখানো হয় সেলাইয়ের কাজ। এসব কাজে সহযোগিতা দিচ্ছে সেভ দ্য চিলড্রেন, গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা ও মুসলিম চ্যারিটিসহ কয়েকটি সংস্থা।
‘এ পর্যন্ত আসতে আমার বারবার বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ও মাস্তানদের জন্য আমি ঘুমাতে পারতাম না। তারা কখনোই চাইত না যৌনকর্মীরা সচেতন হোক, তাদের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হোক। নিজে পড়ালেখা না জানলেও আমি তাদের শিক্ষিত করতে পারছি। এ কাজে স্থানীয় প্রশাসনসহ অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি’, বলেন মর্জিনা।
নিজের কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন মর্জিনা। চারবার পেয়েছেন জয়ীতা পুরস্কার। এ ছাড়া কবি নজরুল ইসলাম সম্মাননা-২০১৫, সমাজসেবা সম্মাননা-২০১৫ ও শের-ই-বাংলা স্বর্ণপদকসহ বেশ কিছু পুরস্কার দেয়া হয়েছে তাকে।
সমাজের অন্য নারীদের জন্য মর্জিনাকে আদর্শ মনে করেন রাজবাড়ী মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক আজমির হোসেন।
বলেন, ‘মর্জিনা রাজবাড়ীর অন্য নারীদের জন্য একজন আইডল। তাকে নিয়ে আমরা প্রাউড ফিল করি। উনি রাজবাড়ীর শ্রেষ্ঠ জয়ীতা। শুধু এখানকার না, সারা দেশের নারীদের জন্যই তিনি আইডল। উনার কথা ছড়িয়ে পড়লে অন্য নারীরাও উৎসাহিত হবেন।’